জর্জ বেস্ট, যিনি হতে পারতেন সবার সেরা : সফলতার ক্ষেত্রে প্রতিভাবান হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ন একটি বিষয়। তবে সফল হতে প্রতিভা থাকতেই হবে এটাও কোনো বেদবাক্য নয়। কিন্তু প্রতিভা সফলতার লড়াইয়ে একজন মানুষকে অন্য সবার থেকে এগিয়েই রাখে। তবে শুধু প্রতিভা থাকলেই চলবে না, সঙ্গে থাকতে হবে নিবেদন। প্রতিভার সঠিক পরিচর্যা করে সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। প্রতিভা আর পরিশ্রম একজন মানুষকে করে আলাদা, বানায় সর্বকালের সেরা। আর প্রতিভার অপচয় মানুষকে তৈরি করে বেস্ট হিসেবে, জর্জ বেস্ট হিসেবে!
যুগে যুগে ফুটবলে কত না রথী-মহারথী এসেছেন। অসাধারণ প্রতিভাবানও এসেছেন কত শত। কে সর্বকালের সেরা এমন প্রশ্নে আছে প্রচুর তর্ক-বিতর্ক। তবে একটা জায়গায় সবার উত্তর এক, প্রতিভার অপচয়ের প্রশ্নে সবার উত্তর ঠেকেছে জর্জ বেস্টের মেরুতে। ফুটবলের বহু বিশ্লেষক এক বাক্যে স্বীকার করে নেন, তার মতো প্রতিভার অপচয় খুব কম ফুটবলারই করেছেন। যা ইচ্ছা তাই করো, জীবনকে উপভোগ করো-খেয়ালী রাজার মতো সবুজ ক্যানভাসে বাঁচো। ফুটবল ইতিহাসের এই খেয়ালী রাজাই জর্জ বেস্ট।
উইংয়ে বল পায়ে অসাধারণ দৌড়, ডিফেন্ডারদের অনায়াসে ড্রিবল করে পিছনে ফেলা নয়তো নাটমেগ করা, সঙ্গে একরাশ আফসোস- তিনি জর্জ বেস্ট। নামের মতোই হতে পারতেন বেস্ট। হয়তো কারো কারো কাছে বেস্টই ছিলেন , তবে সর্বসাধারণের মুখে যেভাবে উচ্চারিত হয় পেলে, দিয়েগো ম্যারাডোনা কিংবা ইয়োহান ক্রুয়েফদের নাম সেখানে জর্জ বেস্টের নাম না থাকাই তো আক্ষেপ। যে আক্ষেপের কারণটাও তিনি, শুধু সবুজ ঘাসের উপর নয় যিনি বেস্ট ছিলেন মদের গ্লাসেও।
মদের নেশা তাকে কতটা পেয়ে বসেছিল সেটা জানা যায় তার কয়েকটা উক্তিতেই। একবার বলেছিলেন, “মদ, মেয়েমানুষ এবং দামি গাড়ির পেছনে আমি উপার্জনের ৮০ শতাংশ টাকা খরচ করেছি। এ ছাড়া আমার জীবনের বাকি সব কিছুই বাজে খরচ।” আরেকবার তো মদ নাকি ছেড়েই দিয়েছিলেন, তবে মদ আর নারীসঙ্গবিহীন তার সময় কেটেছিল মাত্র ২০ মিনিট!
“আমি নারী আর মদ ছেড়ে দিয়েছিলাম। এটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বাজে ২০ মিনিট।”
কিছু মানুষ বৃষ্টিকে অনুভব করে, বাকিরা শুধু গা ভেজায়। বব মার্লের বিখ্যাত উক্তির মতোই জীবনদর্শন ছিল বেস্টের। জীবনকে উপভোগ করো নিজের মতো, জীবন যে উপভোগের সত্যিকারের মঞ্চ। ফুটবলটাও তাই, এজন্য যতদিন ফুটবল খেলেছেন উপভোগের জন্যই খেলেছেন, পাওয়া না পাওয়ার হিসেব হয়তো কোনোদিন করেননি, করলে কি আর সর্বকালের সেরা হওয়ার এমন সুযোগ হেলায় হারাতেন? সর্বকালের সেরা উপাধি একটু বাড়াবাড়ি মনে হতে পারে, কিন্ত যখন শুনবেন বেস্টের মৃত্যুতে সর্বকালের অন্যতম সেরা এক পেলে শোকবার্তায় লিখেছিলেন “বিশ্বের এক নম্বর সেরা ফুটবলারের মৃত্যুতে দুই নম্বর সেরা ফুটবলার শোক জানিয়েছে”, তখন আনমনে চোখটা ভিজে যেতে পারে তর্কসাপেক্ষে সেরা হওয়ার ক্ষমতা রাখা ফুটবলারের সেরা হতে না পারার ব্যর্থতার আক্ষেপে।
“আই থিংক আই হ্যাভ ফাউন্ড আ জিনিয়াস” বেস্টকে যখন প্রথম দেখলেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড স্কাউট বব বিশপ, এভাবেই ইউনাইটেড ম্যানেজার ম্যাট বাসবিকে টেলিগ্রামে জানিয়েছিলেন। তখনও ক্লাব কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারেনি কতবড় অমূল্য রত্নের দেখা তারা পেয়েছে। তা না হলে,মাত্র ১৫ বছরেই সাইন করানো এই হীরাকে শুধুমাত্র নর্দান আইরিশ হওয়ার কারণে দুবছর কাটাতে হয় রেড ডেভিলদের অ্যামেচার দলে? মূল দলে এসেই প্রমাণ করেন নামের সার্থকতা, হয়ে ওঠেন বেস্ট। নামের মধ্যেই যে রয়েছে তার উপাধি- বেস্ট।
ইংলিশ ক্লাব ফুটবলে যে গ্ল্যামার কিংবা ফুটবলারদের সঙ্গে সুন্দরীদের সখ্যতা, সেটার একপ্রকার জন্মই দিয়েছিলেন তিনি। ইংলিশ ক্লাব ফুটবলের গ্ল্যামার বয় বেস্টের পায়ে যেমন ছিল স্কিল তেমনি পারফর্মও করেছেন চোখধাঁধানো। তার একেকটা ম্যাচ দেখা যেন ছিল চোখের শান্তি। তাক লাগানো, মন জুড়ানো পারফরম্যান্সে তাই অতি সহজেই বিমোহিত হতেন সুন্দরীরা। সেই সঙ্গে মদ আর জুয়ার নেশায় তৎকালীন ব্রিটিশ মিডিয়ায় বারবার হতেন সংবাদের শিরোনাম। তিনি যে অন্যের কাঁধে ভর করে নন, বাঁচতে চেয়েছেন শিরোনাম হয়েই।
ইয়োহান ক্রুয়েফের সমসাময়িক ফুটবলার ছিলেন বেস্ট। ডাচ কিংবদন্তির সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতেই তাকে নাটমেগ করেছিলেন, ঘটনা ১৯৭৬ সালের। একবছরের ব্যবধানে দুজনের ক্যারিয়ার শুরু হলেও ততদিনে ক্রুয়েফ চলে গেছেন সেরাদের তালিকায়। নেদারল্যান্ডস এবং নর্দান আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচের আগে এক সাংবাদিকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল বেস্টের। কথাপ্রসঙ্গে সেই সাংবাদিক মেতেছিলেন ক্রুয়েফ বন্দনায়। এমনকি বেস্টকে বলেছিলেন তার চেয়ে ক্রুয়েফ যে ভালো খেলোয়াড় সেটা সে জানে কিনা। এমন প্রশ্নে ভড়কে যাওয়ার বদলে বেস্ট বলেছিলেন মাঠে নেমে তিনি কী করেন সেটা দেখতে।
মাঠে নেমেই নিজের কথামতো কাজ করলেন বেস্ট, প্রথম দেখাতেই ক্রুয়েফের দু পায়ের মধ্যে দিয়ে বল নিয়ে গেলেন। অর্থাৎ নাটমেগ করলেন! পরবর্তীতে ক্রুয়েফ জানিয়েছিলেন বেস্ট যা ছিল তা হওয়ার ক্ষমতা নাকি ছিল না অন্য কারো, বেস্ট নাকি ছিলেন স্বয়ং ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভা।
বল পায়ে দারুণ ব্যালেন্স, মারাত্মক ফিনিশিং আর প্রতিপক্ষের রক্ষণভেদের অতিমানবীয় ক্ষমতা- সবই ছিল বেস্টের মধ্যে। যেন মনে হয় ফুটবল বিধাতা নিজ হাতে ফুটবলীয় সব দক্ষতায় গড়েছেন তাকে। দক্ষতা আর শক্তি, এ দুইয়ের মিশেলে এমন ফুটবলার খুব কমই পেয়েছে ফুটবল।
এজন্য বেস্টকে তুলনা করা যায় শুধুই গ্রীকদেবতা একিলিসের সাথে। জর্জ বেস্ট যেন ছিলেন ফুটবলের একিলিস। সত্যিকারের একিলিসের অমর হতে একমাত্র বাঁধা ছিল তার গোড়ালী, আর ফুটবলের একিলিসের সেই গোড়ালি নামক বাঁধা হচ্ছে মদ আর নারী। হায়! প্রতিভার কি নিদারুণ অপচয়।
[ জর্জ বেস্ট, যিনি হতে পারতেন সবার সেরা ]
আরও পড়ুন :