ক্রিকেটের ক্ষুদ্রতম সংস্করণ, টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এই ফরম্যাটের জনপ্রিয়তা। মূলত চাইবেন, স্বল্প সময়ের খেলা হওয়ায় মুহুর্তেই জনপ্রিয়তা অর্জন করছে খেলাটি, সঙ্গে রয়েছে চার ছক্কার ফুলঝুড়ি। দর্শক হিসেবে আপনি ধুন্ধুমার মারই দেখতে চাইবেন, এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট সেই আবেদন মেটায় পুরোদমে।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের মূল উদ্দেশ্য খেলাটাকে আরো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ করা। স্বল্প বা একেবারে সীমিত ওভারের খেলা হওয়ায় কাগজে কলমে শক্তিশালী দলও কার্যত ফেভারিট নয়, অর্থাৎ নিজের দিনে ভালো খেলে যে কোনো দল জয় ছিনিয়ে নিতে পারে। এটাই দর্শকদের বেশি টানে। মাঠে তুমুল প্রতিযোগিতার সঙ্গে একেবারে ছাড় না দেওয়ার মানসিকতা দর্শকদের খেলাটাকে আপন করে নিতে সাহায্য করছে।
দর্শকরা খেলাটাকে আপন করে নিচ্ছেন এটার আরেকটা উদাহরণ হতে পারে ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের আধিক্য। ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল), বিগ ব্যাশ, পাকিস্তান সুপার লিগ (পিএসএল), বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ (বিপিএল), লঙ্কা প্রিমিয়ার লিগ (এলপিএল) কিংবা ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (সিপিএল) নিয়মিত আয়োজন কিংবা বড় বড় তারকাদের সরব উপস্থিতি, খুব সহজেই দর্শকদের মাঠমুখী করছে। সঙ্গে তাদের দুর্দান্ত পারফর্ম্যান্স হলে তো কথাই নেই!
ক্রিকেটের প্রায় দেড়শ বছরের ইতিহাস। প্রথমে টেস্ট ক্রিকেট দিয়ে শুরু, প্রায় ১০০ বছর পর শুরু হয়েছে ওয়ানডে ক্রিকেট। সময় যত গড়াচ্ছে, ক্রিকেটের ফরম্যাটও তত ছোট হচ্ছে। দিনবদলের পালাক্রমে আস্তে আস্তে ক্রিকেটের ছোট ফরম্যাট তাই মানুষের মনে জায়গা করে নিচ্ছে। তবে কুড়ি ওভারের ক্রিকেটের বয়স কিন্তু খুব বেশিদিন হয়নি। সবেমাত্র দেড় দশক পেরিয়েছে।

২০০৩ সালের ১৩ জুন আন্তঃ কাউন্টি প্রতিযোগিতায় সর্বপ্রথম টি-২০ ক্রিকেট চালু করা হয়, তবে সেটা ছিল পরীক্ষামূলক প্রতিযোগিতা। সেই টি-২০ কাপের প্রথম আসর সফলভাবে আয়োজন করে ইংল্যান্ড এবং ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ড (ইসিবি)। ওয়ারভিকশায়ারকে ৯ উইকেটে হারিয়ে প্রথম আসরের শিরোপা ঘরে তোলে সারে লায়ন্স। তবে এই ফরম্যাট নিয়ে আশাবাদী ছিল না ইসিবি।
তবে প্রথম স্বীকৃত টি-টোয়েন্টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় ২০০৪ সালের ১৫ জুলাই লর্ডসে, মিডলসেক্স এবং সারের মধ্যে। সেই ম্যাচ দেখতে প্রায় ২৮ হাজার দর্শক মাঠে আসে। যেটা কিনা সর্বশেষ ৫০ বছরে কাউন্টি ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি দর্শক উপস্থিতি। এরপরই আস্তে আস্তে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট।
সে বছরই পাকিস্তানে আয়োজন করা হয় ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট। দেশটির বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মোট তেরটি দল গড়া হয়। প্রথম আসরের চ্যাম্পিয়ন হয় ফয়সালাবাদ উলভস। এরপর পরের বছর অর্থাৎ ২০০৫ সালে অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত হয় ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট।
সে বছরের ১২ জানুয়ারি অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ঘরোয়া কুড়ি ওভারের ম্যাচ খেলা হয়। ওয়াকাতে সে ম্যাচে ভিক্টোরিয়া বুশরাঞ্জার্সের প্রতিপক্ষ ছিল ওয়েস্টার্ন ওয়ারিয়রস। প্রায় ২০ হাজার দর্শক মাঠে উপস্থিত হয়েছিল, যেটা কিনা সবশেষ ২৫ বছরে সবচেয়ে বেশি।
অস্ট্রেলিয়া ইংল্যান্ড কিংবা পাকিস্তানে সফল আয়োজনের পর কিংবা দর্শকজনপ্রিয়তা দেখার পর নড়েচড়ে বসে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেট কাউন্সিল (আইসিসি)। তড়িঘড়ি করে আইসিসি আয়োজন করে প্রথম আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট।
২০০৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রথম আন্তর্জাতিক টি-২০ ম্যাচে মুখোমুখি হয় তাসমান পাড়ের দুই দেশ নিউজিল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়া। অকল্যান্ডে ইডেন পার্কের সে ম্যাচে স্বাগতিকদের হারায় অস্ট্রেলিয়া। ঠিক যেভাবে ওয়ানডে ক্রিকেটের প্রথম ম্যাচেই জিতেছিল অজিরা।
উভয় দলই সে ম্যাচে মাঠে নব্বইয়ের দশকের ফিল নিয়ে এসেছিল, জার্সিও ছিল নব্বইয়ের দশকের মতো। কেউ কেউ মাথায় পরচুলা পড়েছিলেন, কেউ কেউ নকল গোফ দাড়ি লাগিয়েছিলেন। সবটাই করা হয়েছে পৃষ্ঠপোষক বেইগ ব্রিগেডের অনুরোধে। প্রথম ম্যাচ কিংবা পরীক্ষামূলক ম্যাচ হওয়ায় কারো মধ্যেই স্বাভাবিক ‘সিরিয়াসনেস’ ছিল না। অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তি পেসার গ্লেন ম্যাকগ্রা মাঠে ফিরিয়ে আনেন ট্রেভর চ্যাপেলের স্মৃতি।
১৯৮১ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে আন্ডার আর্ম বোলিং করেছিলেন, হয়েছিলেন নিন্দিত এবং সমালোচিত। প্রথম আন্তর্জাতিক টি-২০ ম্যাচে গ্লেন ম্যাকগ্রা আন্ডাড় আর্ম বোলিং করেছিলেন, তবে সেটা মজার ছলে।

সে ম্যাচের আম্পায়ার ছিলেন বিলি বাউডেন, মাঠে তার রসিকতা সম্পর্কে সবারই ধারণা আছে। তিনিও মজা করতে ছাড়েননি, ম্যাকগ্রাকে ‘লাল-কার্ড’ দেখান! সাধারণত ক্রিকেটে লাল কার্ড দেখানো হয় না, তাই দর্শকদের মধ্যে হাসির রোল পড়ে যায়।
তবে এর আগেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে টি-টোয়েন্টি চালু হয়। তবে সেটা নারীদের ক্রিকেটে। ২০০৪ সালের ৫ আগষ্ট নিউজিল্যান্ড এবং ইংল্যান্ডের নারীদের মধ্যে প্রথম টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট আয়োজন করা হয়। ইংল্যান্ডে সেই ম্যাচে ৯ রানে জয়লাভ করে সফররত নিউজিল্যান্ড।
সব দলগুলো এরপর টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটকে আপন করে নেয়। বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসিও দর্শকজনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বকাপ আয়োজনের পরিকল্পনা হাতে নেয়। ২০০৭ সালে সাউথ আফ্রিকায় প্রথমবারের মতো মাঠে গড়ায় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ।
২০০৭ সালে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে অনুষ্ঠিত হয়েছিল ওয়ানডে বিশ্বকাপ, একই বছর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ আয়োজন করা ছিল আইসিসির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জ ভালোমতোই পার করেছিল ক্রিকেটের অভিভাবক সংস্থা।
প্রথম আসরে পাকিস্তানকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় ভারত। হ্যাট্রিক, সেঞ্চুরি তো দেখেছেই সেই আসরে বিশ্ব দেখেছে ছয় বলে ছয় ছক্কাও। এমনকি টাই ম্যাচের নিষ্পত্তি হয়েছে বোল আউটের মাধ্যমে।
দুই বছর বাদে আবার অনুষ্ঠিত হয় টি-২০ বিশ্বকাপ, সেই আসরে চ্যাম্পিয়ন হয় পাকিস্তান। পরের বছর তৃতীয় আসরে শিরোপা জেতে ইংল্যান্ড। ২০১০ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত দুই বছর অন্তর অন্তর টি-২০ বিশ্বকাপ মাঠে গড়িয়েছে।তবে এরপর থেকে চার বছর অন্তর অন্তর বিশ্বকাপ আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। তাই আবার প্রতি দুই বছর অন্তর অন্তর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ আয়োজনের পথে আইসিসি।
[ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ; ছোট প্যাকেটে বড় ধামাকা ]
টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ সম্পর্কে আরও পড়ুন:
“টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ; ছোট প্যাকেটে বড় ধামাকা”-এ 2-টি মন্তব্য