নারীরা পুরুষদের ছাড়িয়ে : একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ অর্থাৎ ওয়ানডে ক্রিকেটে ডাবল সেঞ্চুরির আবেদন ছিল অনেকদিন ধরেই। কিন্ত অনেক চেষ্টা করেও অধরা দ্বিশতক ধরা দিচ্ছিল না। অনেকেই চেষ্টা করেছিলেন, সাঈদ আনোয়ার, চার্লস কভেন্ট্রি, সৌরভ গাঙ্গুলী কিংবা মহেন্দ্র সিং ধোনিরা বড়জোর খুব কাছেই পৌঁছাতে পেরেছিলেন! ক্রিকেট ভক্তদের সেই আক্ষেপ মেটান একজন, যার সবচেয়ে বেশি যোগ্যতা ছিল এই রেকর্ডের মালিক হওয়ার।
২০১০ সালে ভারতের মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে মাস্টার ব্লাস্টার শচীন টেন্ডুলকার অপরাজিত ২০০ রানের ইনিংস খেলেন। মাঠ-টিভি মিলিয়ে অনেক মানুষই ওয়ানডে ক্রিকেটের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরির ইতিহাসের সাক্ষী হয়েছিল।তবে যদি বলা হয়, টেন্ডুলকারের আগেই একজন ওয়ানডেতে এই কীর্তি গড়েছেন, তাহলে কারো কি বিশ্বাস হবে?
– হওয়ার কথা নয়, অনেকে হয়তো তর্কও করতে আসবেন। তবে আসল ঘটনা হচ্ছে টেন্ডুলকারের আগেই একজন পেয়েছিলেন দ্বিশতকের দেখা। আবার যখন শুনবেন সেই রেকর্ডের মালিক একজন নারী, তাহলে চোখ কপালে উঠে যেতে পারে যে কারো।
কিন্ত পরিসংখ্যান বলে, লিটল মাস্টারের ১৩ বছর আগেই ডাবল সেঞ্চুরি করেছেন অস্ট্রেলিয়ান নারী ক্রিকেটার বেলিন্ডা ক্লার্ক। ১৯৯৭ নারী বিশ্বকাপে ডেনমার্কের নারীদের বিপক্ষে অপরাজিত ২২৯ রানের ইনিংস খেলেছিলেন তিনি। কাকতলীয় হলেও সেটিও ভারতের মাটিতেই! অর্থাৎ ক্রিকেটের দুই বিরল রেকর্ডের জন্ম হয়েছে ভারতেই।
১৯৯৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর নারী বিশ্বকাপে এই ম্যারাথন ইনিংসটি খেলেন অস্ট্রেলিয়ার অধিনায়ক ক্লার্ক। মুম্বাইতে সেদিন দুর্বল ডেনমার্ককে তুলোধুনো করে ১৫৫ বলে ১৪৭.৭ স্ট্রাইক রেটে ২২ চারের মাধ্যমে ডানহাতি ব্যাটসম্যান করেন অপরাজিত ২২৯ রান।
অস্ট্রেলিয়ার দেওয়া ৪১৩ রানের পর্বতসম রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ৪৯ রানে অল আউট হয়ে যায় ডেনমার্ক। সেখানেও নায়ক ক্লার্ক! বল হাতে শিকার করেন পাঁচ উইকেট। কোনো ওয়ানডেতে ২০০ রান আর পাঁচ উইকেট শিকারি একমাত্র অলরাউন্ডার তিনি! ডাবল সেঞ্চুরি করার পাশাপাশি একই ম্যাচে ন্যুনতম একটি উইকেট নিয়েছেন ক্লার্ক বাদে এমন নজির আছে আর একজনের, তিনি ক্রিস গেইল।
২০১৫ বিশ্বকাপে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ডাবল সেঞ্চুরি করার পাশাপাশি শিকার করেন ২ উইকেট। আরেকটি কাকতলীয় ব্যাপার, ক্লার্কের পর গেইলই একমাত্র ক্রিকেটার যিনি কিনা তার ডাবল সেঞ্চুরির ম্যাচে হাত ঘুরিয়েছেন।
সারা বছর প্রচারের আলো পড়ে না নারী ক্রিকেটে। পাদপ্রদীপের সব আলো কেড়ে নেয় ছেলেদের ক্রিকেট। শুধুমাত্র বিশ্বকাপ চলাকালীন সময়ই সোশ্যাল মিডিয়ায় হাজারও শুভেচ্ছাবার্তা পায় নারী ক্রিকেটাররা। টুর্নামেন্ট শেষ মানেই যেন নারী ক্রিকেটের প্রয়োজন শেষ। ফের সেই দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে নারী ক্রিকেটের রোডম্যাপ খুঁজে বেড়াতে হয়। কিন্ত ক্রিকেটে নারীদের অবদান চলছে ছেলেদের ক্রিকেটের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের ছাড়িয়েও! অবাক হচ্ছেন?
ওয়ানডে ক্রিকেটের তো বটেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সবচেয়ে মর্যাদার আসর ধরা হয় ওয়ানডে বিশ্বকাপকে। কিন্তু ক’জনই বা খোঁজ রাখেন কিংবা জানেন যে ছেলেদের বিশ্বকাপের অনেক আগেই শুরু হয়েছিল নারী ক্রিকেটে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন খোঁজার প্রতিযোগিতা?
১৯৭৫ সালে পুরুষদের ওয়ানডে বিশ্বকাপ শুরু হলেও তারও দু’ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৭৩-সালে প্রথমবার বিশ্বকাপ মঞ্চে দেখা গিয়েছিল নারী ক্রিকেটারদের।
একুশ শতকের আগে ওয়ানডেতে তিন’শ রান ছিল সোনার হরিণ, ২৫০ রান হলেই অনেকটা জয় নিশ্চিত হয়ে যেত! এখন দিন বদলেছে, ৩০০রানও এখন নিরাপদ নয় মডার্ন ক্রিকেটে। হরহামেশাই ৩৫০-৪০০ রান হচ্ছে। কিন্ত ক্রিকেটে এই দিনবদলের ডাক প্রথম কারা দিয়েছিলেন জানেন?
– কিউই নারীরা!
২৯ জুন ১৯৯৭ সালে কিউই নারীরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ৫ উইকেটে ৪৫৫ রানের পাহাড় গড়ে। পুরুষদের ক্রিকেটে প্রথম ৪০০ রান দেখা যায় তারও ৯ বছর পরে। অস্ট্রেলিয়া দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ৪৩৪ রানের রেকর্ড গড়ে। দক্ষিণ আফ্রিকা আবার সেই রান তাড়া করে জয়ের বন্দরে পৌঁছায়!
সর্বোচ্চ রানের ব্যবধানে জয়ের রেকর্ড কাদের দখলে?
-এখানেও জয়জয়কার নারীদের। প্রথম সাতটি রেকর্ডের মালিক নারীরা, যার চারটি আবার কিউই নারীদের দখলে! ১৯৯৭ সালের ২৯শে জুন ইতিহাসের প্রথম ৪০০+ স্কোরের ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের করা ৪৫৬ রানের জবাবে পাকিস্তানের নারীরা অলআউট হয় মাত্র ৪৭ রানে! তাই ৪০৮ রানের বিশাল জয় পান নিউজিল্যান্ডের নারীরা।
সর্বকনিষ্ঠ ওয়ানডে সেঞ্চুরিয়ান কে?
-যতদূর সবাই জানে, এটা শহীদ আফ্রিদি। কিন্ত আদতে এটাও সত্যি নয়! এ রেকর্ডের মালিক একজন ভারতীয় নারী। নারী ক্রিকেটের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান মিথালি রাজের দখলে এই রেকর্ড।
৩৭ বলে ১০০ রান করার অনন্য রেকর্ড শহিদ আফ্রিদির এবং সাথে সাথে কম বয়সে সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরি করার রেকর্ডও তার। মাত্র ১৬ বছর ২১৭ দিন বয়সে সেঞ্চুরি করেন। তার প্রায় দুই বছর পর ১৯৯৯ সালে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ভারতের ব্যাটসম্যান মিথালি রাজ আফ্রিদির থেকে ১২ দিন কম বয়সে সেঞ্চুরি করার রেকর্ড করেন।
সবচেয়ে কম বয়সে ফাইফার নেয়ার কৃতিত্ব পাকিস্তানি কিংবদন্তি পেসার ওয়াকার ইউনুসের! ১৯৯০ সালে শ্রীলংকার বিরুদ্ধে মাত্র ১৮ বছর ১৬৪ দিন বয়সে ২৬ রান দিয়ে ৬ উইকেট নেয়ার রেকর্ড করেন তিনি! কিন্ত আদতে সেই রেকর্ড একজন নারীর! ২০০৩ সালে তারই স্বদেশী সাজ্জিদা শাহ জাপানের বিরুদ্ধে ৪ রান দিয়ে ৭ উইকেট নেয়ার বিরল এক রেকর্ড গড়েন।
বর্তমানে ক্রিকেটের অনেক আবেদন কেড়ে নিয়েছে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট! ক্রিকেটের শর্টার ফরম্যাট অনেক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে, ২০০৫ সালে নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট অনুষ্ঠিত হয়। কিন্ত আপনি কি জানেন আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি সর্বপ্রথম চালু হয় নারীদের ক্রিকেটে?
হয়তো অবাক হবেন, ২০০৪ সালে নিউজিল্যান্ডের নারীরা ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম টি টুয়েন্টি ম্যাচ খেলে, যে ম্যাচে নয় রানে জয়লাভ করে কিউইরা।
এখন পর্যন্ত এশিয়া কাপে তিনবার ফাইনালে খেলেছে টাইগাররা, অধরা শিরোপা ছুঁতে পারে নি কোনোবারই। একবার প্রতিপক্ষ পাকিস্তান আর বাকি দুইবার ভারত। ভারত জুজু কাটাতে ব্যর্থ আরও একবার, নিদাহাস ট্রফিতে। সাকিব-মাশরাফিরা না পারলেও সালমা-জাহানারারা ঠিকই পেরেছেন। ভারতকে হারিয়ে ২০১৮ এশিয়া কাপের শিরোপা ঠিকই পকেটে পুড়ে সালমা বাহিনী, অনুর্ধ-১৯ বিশ্বকাপ ব্যতীত যা বাংলাদেশের একমাত্র বৈশ্বিক কোনো শিরোপা।
এই সব রেকর্ড চাইলেও হয়তো পুরুষরা ভাঙতে পারবেন না। কিন্ত পার্থক্য শুধু তারা নারীদের ক্রিকেটের প্রতিনিধি। তাই হয়তো হাজার খুঁজলেও নারী ক্রিকেটে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিয়ানের একটাও ভাল মানের ভিডিও ক্লিপ পাওয়া যায় না! যা ভরসা তা ওই কিছু স্টিল ফটোগ্রাফ।
[ নারীরা পুরুষদের ছাড়িয়ে ]
আরও পড়ুন :