ফুটবলকে বিদায় জানালেন কার্লোস তেভেজ: কার্লোস তেভেজ, জীবনযুদ্ধে জয়ী একজন ফুটবলার। তেভেজ শৈশব থেকেই কঠিন সংগ্রাম করে জীবনযুদ্ধে লড়াই করে পেয়েছেন নিজের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য, হয়েছেন একজন আর্জেন্টাইন ফুটবল কিং। ব্যাক্তিগত জীবন নানারকম সমস্যায় জর্জরিত থাকার পরেও হাল ছাড়েননি তেভেজ। যার কারণে, তেভেজ আর্জেন্টাইন ফুটবল ইতিহাসে একজন কিংবদন্তী খেলোয়াড় হিসেবেই স্থান পেয়েছেন।
তেভেজের জন্ম হয়েছিল একটা দরিদ্র পরিবারে। আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্সের কুখ্যাত এলাকা ফোর্ট অ্যাপাচি’র রাস্তার পাশে এক বস্তিতে জন্ম নিয়েছিলেন তেভেজ। নিজের ছোটবেলায় খাবার কিনে খাওয়ার সামর্থ্যটুকুও ছিল না তার।
জন্মের পরপরই তেভেজের বাবা মা তাকে পরিত্যক্ত করেছিলেন। এরপর, শৈশব থেকে বড় হয়েছেন চাচার কাছে। তার চাচার ছিল পাঁচ সন্তান। প্রতিনিয়ত প্রতিবেশীদের রক্তক্ষয়ী মারামারি দেখেই বড় হয়েছেন কার্লোস তেভেজ। এমনকি, বাল্যকালের ঘনিষ্ঠ এক বন্ধুকে চোখের সামনে গুলি খেয়ে মারা যেতেও দেখেছেন। এতসব, প্রতিকূলতার মধ্যে বেড়ে ওঠা তেভেজ ফুটবল খেলার অনুপ্রেরণা পেয়েছেন চাচার কাছ থেকে।
[ ফুটবলকে বিদায় জানালেন কার্লোস তেভেজ ]
দশ মাস বয়সে গায়ে গরম পানি পড়ে, শরীরে তৃতীয় মাত্রার পোড়া ক্ষত সৃষ্টি হয় তেভেজের। এর ফলে তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে প্রায় ২ মাস থাকতে হয়। কিন্তু তাদের দারিদ্র্য এতটাই তীব্র ছিল যে, দাগ মোছার জন্য সেভাবে চিকিৎসা করানো যায়নি।
ম্যারাডোনারই রেকর্ড ভেঙে সবচেয়ে কম বয়সে ‘দক্ষিণ আমেরিকান বর্ষসেরা ফুটবলার’ এর পুরস্কার জিতেছিলেন তেভেজ। ২০০৪ সালে, তার হাত ধরেই অলিম্পিক গেমসে ফুটবলে সর্বপ্রথম স্বর্ণপদক পায় আর্জেন্টিনা। সে টুর্নামেন্টে মোট ৮ গোল করে আর্জেন্টিনা মূল দলে সুযোগ পেয়ে যান তেভেজ।

২০০৪ সালের কোপা আমেরিকার দলে তেভেজ সুযোগ পেয়ে অসাধারণ পারফর্মও করেন। কোয়ার্টার ফাইনালে পেরুর বিপক্ষে তেভেজের একমাত্র গোলেই আর্জেন্টিনা ১-০ গোলের জয় পায়। এছাড়াও, সেমিফাইনালেও কলম্বিয়ার বিপক্ষে ৩-০ গোলে জয়ের প্রথমটা তেভেজের। ফাইনালটা আর্জেন্টিনার হাতেই ছিল। ৯০ মিনিট পর্যন্ত এগিয়ে ছিল ২-১ গোলে। ৯২তম মিনিটে তেভেজকে সাব করা হয়, এবং ৯৩তম মিনিটেই আদ্রিয়ানোর ঝলকে সমতা ফেরায় ব্রাজিল।
আর্জেন্টিনার হয়ে ২০০৬ এবং ২০১০ ফিফা বিশ্বকাপে দলে সুযোগ পান তেভেজ। যদিও, সে বিশ্বকাপে নিজের ব্যক্তিগত পারফর্মেন্সের দিক দিয়ে নামের প্রতি সুবিচার করতে পারেনি তেভেজ। ২০১৫ সালে, প্যারাগুয়ের বিপক্ষে বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের ম্যাচের মাধ্যমে আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে নিজের শেষ ম্যাচ খেলেন তেভেজ।

জাতীয় দলের হয়ে তেমন প্রত্যাশিত ফলাফল না করতে পারলেও ক্লাব জার্সি গায়ে বরাবরই উজ্জ্বল ছিলেন তেভেজ। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই ২০০১ সালে বোকা জুনিয়র্সের হয়ে ‘আর্জেন্টাইন প্রিমিয়ার ডিভিশন’-এ অভিষেকের পর বোকা জুনিয়র্সের হয়ে ২০০৩ সালে জেতেন প্রিমিয়ার ডিভিশনের শিরোপা।সে একই বছরে ব্রাজিলিয়ান ক্লাব সান্তোসকে হারিয়ে জেতেন দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ টুর্নামেন্ট কোপা লিবা্ররতোদোসের শিরোপা। সে আসরে তেভেজ আসরের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচিত হন।
২০০৪ সালের কোপা সুদামেরিকানার ফাইনালটা জেতার পেছনেও তেভেজের অবদান ছিল। বলিভারের বিপক্ষে ফাইনালের প্রথম লেগে ১-০ গোলে হারার পর নিজেদের মাঠে দ্বিতীয় লেগে প্রয়োজন ছিল ২-০ গোলের জয়। তেভেজের গোলেই ২-০ গোলের জয়টা নিশ্চিত করে বোকা জুনিয়র্স।
২০০৫ সালে ব্রাজিলিয়ান ক্লাব করিন্থিয়ানস তাদের পরিকল্পনায় নিয়ে এলো তেভেজকে। সে মৌসুমেই ৬ বছর পর করিন্থিয়ানস লিগ জিতলো, এবং তেভেজ জিতলেন লিগের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার। এছাড়া তেভেজ জিতলেন টানা তৃতীয়বারের মতো দক্ষিণ আমেরিকান বর্ষসেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার।
তেভেজ ২০০৫ সালে যোগ দেন ইংলিশ ক্লাব ওয়েস্ট হাম ইউনাইটেডে। সেখানে, দলকে রেলিগেশনের হাত থেকে রক্ষা করে পরের মৌসুমে যোগ দেন ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে তিন মৌসুম খেলে ২টি লিগ, ১টি লিগ কাপ, ১টি কম্যুনিটি শিল্ড, ১টি চ্যাম্পিয়ন্স লিগ এবং ১টি ক্লাব বিশ্বকাপের শিরোপা জিতেন তেভেজ।

এরপর ২০০৯-১০ মৌসুমে ম্যানসিটিতে যোগ দান করেন তেভেজ। ম্যানসিটিতে ৪ মৌসুম খেলে ৪ মৌসুম খেলে ১টি লিগ, ১টি এফএ কাপ এবং ১টি কম্যুনিটি শিল্ড জেতেন তেভেজ এবং ২০১১-১২ মৌসুমের লীগের গোল্ডেন বুটও জেতেন তিনি।

এরপর জুভেন্টাসের হয়ে মাঠ মাতান তেভেজ। ইতালির ক্লাবটির হয়ে দুবার সিরি আর শিরোপা জিতেছেন তিনি। সেখান থেকে চাইনিজ লিগে গিয়েও লিগ শিরোপা জেতেন আর্জেন্টাইন তারকা। এরপরে, খেলোয়াড়ই জীবনের শেষের দিকে ফিরে আসেন প্রিয় ক্লাব বোকা জুনিয়র্সে।
আজ ২০ বছরের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের ইতি টানলেন আর্জেন্টিনার তারকা ফুটবলার কার্লোস তেভেজ। ৩৮ বছর বয়সে ফুটবলকে বিদায় বললেন তিনি। তার অবসরের খবরটি নিশ্চিত করেছে শীর্ষ আর্জেন্টাইন সংবাদমাধ্যম টিওয়াইসি স্পোর্টস। আজ শনিবার এক আর্জেন্টাইন সাংবাদিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নিজের অবসরের বিষয়টি নিশ্চিত করেন তেভেজ।
আরও পড়ুন: