বার্সা-রিয়াল; মাঠের লড়াই নাকি রাজনীতি?

বার্সা-রিয়াল; মাঠের লড়াই নাকি রাজনীতি? মাঠের খেলার নাকি রাজনীতি মেশাতে নেই। তবে যুগ যুগ ধরে খেলার ঐতিহ্য বাইরের রাজনীতিই। বর্তমান সময়ে ফুটবলের সবচেয়ে বড় দ্বৈরথ বার্সা-রিয়াল মাদ্রিদের ধ্রুপদী লড়াই। বর্তমান সময়ে ক্লাব ফুটবলের এই দ্বৈরথের অতীত ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে সূচনা ঐ রাজনীতির হাত ধরেই।

বার্সা-রিয়াল
বার্সা-রিয়াল; মাঠের লড়াই নাকি রাজনীতি

বার্সা-রিয়ালের ধ্রুপদী লড়াইয়ের পোশাকি নাম ‘এল ক্ল্যাসিকো’। ক্লাব ফুটবলের অন্য সব লড়াইয়ের থেকে আলাদা স্প্যানিশ দুই জায়ান্টের মাঠের লড়াই। কারণও আছে, ক্লাব ফুটবলের আর সব দ্বৈরথ শহর কেন্দ্রিক। ম্যানচেস্টার ডার্বি, উত্তর লন্ডন ডার্বি, লন্ডন ডার্বি, লিভারপুল ডার্বি কিংবা মিলান- একই শহরের দুই ক্লাব হয়ে ওঠে ‘চিরশত্রু’। একই শহরের দুই দলের কারো মুখ দেখাদেখি বন্ধ, কথার লড়াই তো আছেই।

বাংলাদেশের আবাহনী-মোহামেডানের কথাই ধরুন না। তবে তা বর্তমান সময়ের থেকে অতীতে গেলে উদাহরণ আরো পাকাপোক্ত হবে। বাপ-দাদার কাছে শোনা, ঢাকা ডার্বি অর্থাৎ আবাহনী-মোহামেডানের ম্যাচের দিন পুরো স্টেডিয়াম পাড়ায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করত। পুরো বাংলাদেশে উৎসবমুখর পরিবেশ। মাঠের লড়াই রুপ নিতো মারামারিতে, সেই মারামারি পৌছে যেত গ্যালারিতে, মাঠের বাইরে। একই শহরের দুই দলের লড়াইয়ের এমন গল্প তো স্বাভাবিক। কিন্তু ব্যাতিক্রম ভিন্ন দুই শহরের দুই দলের লড়াইয়ে…

Real Madrid CF, রিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাবের লোগো
Real Madrid CF, রিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল ক্লাবের লোগো

ভিন্নতার অনেক উদাহরণ আছে, তবে সবচেয়ে বেশি বোধহয় বার্সা-রিয়াল। মাঠের খেলার ধরণ থেকে শুরু করে জার্সির ডিজাইন। এমনকি জার্সির স্পন্সরেও আছে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। এ পাড়ায় লাল-নীল ডোরাকাটা জার্সি, ও পাড়ায় সাদা শুভ্রতা। মাদ্রিদের ক্লাবটি খেলে গতিময় ফুটবল, কাতালানের ক্লাবের মূলমন্ত্র পাসিং। এ সবই বার্সেলোনা আর রিয়াল মাদ্রিদের ভিন্নতার প্রতীক। দুটো শহরের মধ্যে প্রায় সাড়ে ছয়শ কিলোমিটার দূরত্ব, এই দূরত্ব দুই ক্লাবের দর্শনেও এনেছে বিস্তর ফারাক।

রিয়াল-বার্সার লড়াই শুধুই খেলার মাঠে সীমাবদ্ধ নয়, এ কথা আগেই বলা হয়েছে। সঙ্গে লড়াইটা রাজনীতিরও। বার্সেলোনা মূলত খেটে খাওয়া মানুষের প্রতীক। আর রিয়াল মাদ্রিদ মানেই তো আভিজাত্য। স্পেনের এই দুই শহরের মধ্যে ভিন্নতা কী খুঁজবেন, দুই শহরের মধ্যে মিলই খুজে পাওয়া দুস্কর। একদিকে স্বাধীনতাকামী কাতালানরা, অন্যদিকে বিংশ শতাব্দীতে পুরো ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের একনায়ক ফ্রাঙ্কোর দল রিয়াল।

রিয়ালের সাবেক নাম মাদ্রিদ এফসি। ফ্রাঙ্কো এসে তাতে যুক্ত করলেন রয়্যাল শব্দটি, যেটির মানেই রাজকীয়তা। তাদের খেলাতেও সেই আভিজাত্য। একই আভিজাত্যে ইউরোপ শাসনও। রিয়ালই একমাত্র ক্লাব, ইউরোপিয়ান কাপ জয়ের সংখ্যা যাদের দুই অঙ্ক ছুঁয়েছে, সঙ্গে দুইবার জিতেছে টানা তিনবার করে। নামের সঙ্গে রয়্যাল শব্দ, নামের মহিমা তো একেই বলে। রাজাদের অহংকার তো তাদেরই মানায়।

Barcelona FC Logo, ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনা এর লোগো
Barcelona FC Logo, ফুটবল ক্লাব বার্সেলোনা এর লোগো

রাজাদের আভিজাত্য আছে, তবে খেটে খাওয়া মানুষের থাকে সাহস। নিজেদের অকাতরে বিলিয়ে দেওয়ার সাহস, স্বাধীন-আকাঙ্ক্ষাই তাদের সবচেয়ে বড় শক্তি। তাদের স্বাধীনতার মূল কান্ডারি ফুটবল। ভিনদেশি সুইস নাগরিকের হাতে গড়া ক্লাব বার্সাই কাতালুনিয়ার স্বাধীনতা স্বপ্নের মূল সোপান। কাতালুনিয়ার স্বাধীনতার লড়াইয়ের অন্যতম প্রেরণাকেন্দ্র মাঠের ফুটবল, যার নেতৃত্বে ছিল বার্সেলোনা।

ফ্রাঙ্কোর ৩৯ বছরের দীর্ঘ শাসনে এক ন্যু ক্যাম্পে এসে প্রকাশ্যে স্লোগান দিতে পারত সবাই। যেখানে জেনারেলের উর্দি বাহিনীও ঢোকার সাহস করেনি। আবার ফ্রাঙ্কোও তাঁর রাজত্ব যেমন ধরে রেখেছিলেন এই চ্যালেঞ্জের মুখে, রিয়াল মাঠেও হারায়নি তার আভিজাত্য।

স্পেনের রাজধানী মাদ্রিদে প্রতিষ্ঠিত ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদ। ফ্রাঙ্কোর শাসনব্যবস্থা মূলত মাদ্রিদ-কেন্দ্রিক, তার উপরে সেটা তার নিজের ক্লাব হওয়ায় রিয়াল মাদ্রিদকে কখনও শাসকের রোষানলে পড়তে হয়নি। সেসময়ে ইউরোপীয় পর্যায়ের ফুটবলে সর্বোচ্চ সফলতা তাকে বেজায় উচ্ছ্বসিতই করে।

বার্সা-রিয়াল
বার্সা-রিয়াল; মাঠের লড়াই নাকি রাজনীতি

তার এমন একটা ক্লাবের প্রয়োজন ছিল, যার সাফল্যকে তিনি নিজের শাসনের সাফল্য হিসেবে প্রচার করতে পারবেন। রিয়াল মাদ্রিদ তার সেই আশাকে পূরণ করে। যতটুকু চেয়েছিলেন তার থেকে বেশি পেয়ে যাওয়ায় ক্লাবকে আরো বেশি সুবিধা দিতে থাকেন। এমনকি ইতিহাস বলে স্পেনের রাজপরিবারও রিয়াল মাদ্রিদ বলতেই অন্ধ ছিল।

স্বাভাবিকভাবেই একনায়ক বা স্বৈরশাসকদের আমলে যা হয় আর কি, কেউ বা কোনো দল তার বিরোধিতা করলে তাদের চরম অত্যাচার করা হয়। ফ্রাঙ্কোর আমলেও একই ঘটনা, তার বিরোধিতা যারা করেছিল তাদের চরম অত্যাচার করা হয়। স্পেন থেকে আলাদা হয়ে আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল কাতালানরা।

সেজন্য তাদের উপর চরম অত্যাচার করা হয়, সঙ্গে রাজনৈতিক অধিকারও কেড়ে নেয়া হয়। সকল কাতালান প্রতিষ্ঠানকে নিষিদ্ধ করা হয়, তাদের মুখের ভাষাও কেড়ে নেওয়া হয়। কাতালানদের বলা হতো বিচ্ছিন্নতাবাদী, ফলে অনেক কাতালান নাগরিকের ঠিকানা হতো জেল। জেলের মধ্যে হত্যা, নিপিড়নের ঘটনা তো নিতান্ত স্বাভাবিক ঘটনা।

কাতালানদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে কোনোভাবেই সহ্য করতে পারতেন না ফ্রাঙ্কো, সেই প্রভাব পড়েছিল শহরটার ক্লাব বার্সেলোনার উপর। ১৯৩৬ সালে ফ্রাংকোর সৈন্যরা বার্সেলোনার তৎকালীন প্রেসিডেন্টকে অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করে হত্যা করে। ধারণা করা হয় এর কারণ ফুটবলীয় প্রতিদ্বন্দ্বিতার থেকে রাজনৈতিক বিরোধ। তখন বার্সার খেলোয়াড়দের জার্সি থেকেও কাতালুনিয়ার সকল চিহ্ন ও প্রতীক মুছে ফেলতে নির্দেশ দেয়া হয়।

Real Madrid CF, রিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল দল
Real Madrid CF, রিয়াল মাদ্রিদ ফুটবল দল

বার্সা-রিয়াল ফুটবলের ইতিহাসের সবচেয়ে লজ্জাজনক ঘটনা ঘটে এর ৭ বছর পর। ১৯৪৩ সালের ১৯ জুন, দ্বিতীয় লেগে মাঠে নামে দুই চির প্রতিদ্বন্দ্বি। প্রথম লেগে ৩-০ তে জিতে বার্সা সমর্থকেরা মাঠেই উল্লাস করে। ফ্রাঙ্কোর সমর্থন পাওয়া দল হওয়ায় যতবারই রিয়ালের ফুটবলাররা পায়ে বল পাচ্ছিল, বার্সা বার্সা সমর্থকদের ‘দুয়োর’ শিকার হচ্ছিলেন। মাদ্রিদ সমর্থকরা সেটা ভুলতে পারেনি। দ্বিতীয় লেগে সেটা সুদে আসলে ফিরিয়ে দেয় গ্যালাক্টিকো সমর্থকরা।

২০ হাজার ক্ষিপ্ত মাদ্রিদ সমর্থক রক্ত ঝরানোর গান গাচ্ছিল। তারা এতটাই হিংস্র হয়ে উঠেছিল যে বার্সা প্লেয়ারদের মাথা কেটে ফেলার কথাও বলছিল বারবার। এমন গান ভয়ের উদ্বেগ সৃষ্টি করে বার্সা ফুটবলারদের থেকে শুরু করে বার্সার সবাই।

সেই ভয় আরো বাড়িয়ে দেন ফ্রাঙ্কো, ম্যাচের আগে বার্সা ড্রেসিংরুমে গিয়ে মনে করিয়ে দেন, তাদের অস্তিত্ব টিকে মাদ্রিদের দয়াতেই! সেই আতঙ্কই মাঠে প্রকাশ পায়, মাদ্রিদের জয় ১১-১! রিয়ালের ১১ গোলের আটটিই এসেছিল ম্যাচের প্রথমার্ধে। সেই থেকে বার্সা-রিয়াল ম্যাচ মানেই বাড়তি উত্তাপ, যা চলবে প্রবাহমানকাল ধরে…

[ বার্সা-রিয়াল; মাঠের লড়াই নাকি রাজনীতি? ]

আরও পড়ুন:

Leave a Comment