মিলখা সিং [ Milkha Singh ], দ্যা ফ্লায়িং শিখ [ The Flying Sikh ] : ‘ভাগ মিলখা ভাগ [ Bhaag Milkha Bhaag ]’, বলিউডের ব্যবসা সফল সিনেমাগুলোর মধ্যে একটা। ফারহান আখতার [ Farhan Akhtar ] , সোনম কাপুর [ Sonam Kapoor ] অভিনীত সিনেমা জিতেছে ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড, ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ডের মতো বড় পুরস্কার। বক্স অফিসে সুপার হিট এই সিনেমাটি নির্মিত হয়েছে ‘দ্য রেস অব মাই লাইফ’ অটোবায়োগ্রাফির উপর ভিত্তি করে। যেটা ভারতীয় অ্যাথলেট মিলখা সিং [ Milkha Singh ]য়ের বায়োপিক। সেই মিলখা সিং [ Milkha Singh ], যিনি কিনা পুরো বিশ্বে পরিচিত ছিলেন ‘ফ্লাইং শিখ [ The Flying Sikh ]’ নামে।
![মিলখা সিং [ Milkha Singh ], দ্যা ফ্লায়িং শিখ [ The Flying Sikh ] 2 মিলখা সিং, দ্যা ফ্লায়িং শিখ, Milkha Singh](/wp-content/uploads/2021/12/Milkha-Singh-1-240x300.jpg)
মজার বিষয় হচ্ছে এই সিনেমার জন্য সোনম কাপুর পারিশ্রমিক নিয়েছিলেন মাত্র ১১ রুপি, অন্যদিকে ফারহান আখতার বিনা পারিশ্রমিকেই শেষ করেছিলেন সিনেমার কাজ৷ আর যাকে নিয়ে এই বায়োপিক,সেই মিলখা-সিং তার জীবনের গল্পের সত্ত্ব বিক্রী করেছেন মাত্র ১ রূপিতে৷
নামের পাশে চারটি এশিয়ান গেমসের স্বর্ণপদক, কমনওয়েলথ চ্যাম্পিয়ন কিংবা তিনবার অলিম্পিকে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করা লেখা থাকবে, লেখা থাকবে না তার জীবনযুদ্ধ। খুঁজে পাওয়া যাবে না তার সংগ্রাম, রেকর্ডবইয়ে মিলবে না সত্যিকারের অর্জনের ইতিহাস।
সফল মানুষের ব্যর্থতার ইতিহাসই যে একেকটা অনুপ্রেরণার গল্প, সে খবর কেই বা রাখে। আর দশজন অ্যাথলেটের মতো ছিলোনা তার জীবনযুদ্ধ। এমন একজন মানুষের বায়োপিকে অভিনয় করতে নামমাত্র পারিশ্রমিক নিয়েছেন অভিনেতারা। অনেকেই আবার কাজ করেছেন বিনামূল্যে।
১৯২৯ সালে অবিভক্ত ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের গোবিন্দপুর গ্রামে একটি শিখ রাজপুত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন মিলখা-সিং। দেশ- বিভাগের সাম্প্রদায়িকতার আগুন তখন ভারতীয় উপমহাদেশের বুকে, মিলখার বয়স তখন ১২। ১৫ জন ভাইবোনের মধ্যে ৮ জন দেশভাগের আগেই মারা যান। দেশভাগের সময়ও চোখের সামনে বাবা-মাকে খুন হতে দেখেন ছোট্ট মিলখা। মারা যাওয়ার আগে বাবা শেষবার চিৎকার করে বললেন, ‘ভাগ, মিলখা ভাগ!’ সেই শুরু, এরপর আর থামানো যায়নি মিলখাকে।
প্রাণভয়ে ট্রেনের আসনের নিচে লুকিয়ে ছিলেন, অনেক কষ্টে মুলতান থেকে পালিয়ে আসতে পেরেছেন। দেশভাগের পর দিল্লিতে এক দিদির কাছে আশ্রয় পান মিলখা। সেই থেকে শুরু হয় জীবনযুদ্ধের নতুন লড়াই।
পেছনে টায়ার বেঁধে দৌড়াতে দৌড়াতে কৈশোর পেরিয়ে একদিন পৌঁছে গেছেন অলিম্পিকের ময়দানে। তবে ভারত-পাকিস্তান বিভাজনের পরেও পাকিস্তান সম্পর্কে মিলখার মনে কাজ করত এক বিশাল ভীতি। ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের ইভেন্টেও পাকিস্তানে যাওয়ার প্রসঙ্গ উঠলেই এড়িয়ে যেতেন মিলখা।
![মিলখা সিং [ Milkha Singh ], দ্যা ফ্লায়িং শিখ [ The Flying Sikh ] 4 মিলখা সিং, দ্যা ফ্লায়িং শিখ, The Vice President, Shri M. Venkaiah Naidu presenting the Punjab University Khel Rattan Award to Padma Shree Milkha Singh, at the 67th Convocation of Panjab University, in Chandigarh on March 04, 2018.](/wp-content/uploads/2021/12/The-Vice-President-Shri-M.-Venkaiah-Naidu-presenting-the-Punjab-University-Khel-Rattan-Award-to-Padma-Shree-Milkha-Singh-300x178.jpg)
প্রতিভাবানদের জীবনের গল্প বিধাতা কি এভাবেই লিখেন? বারোতেই নিজের সবকিছু হারিয়েছেন। মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না। খাওয়াও জুটত না রোজ। অভাবে স্বভাব নষ্টের মতো খিদের জ্বালায় ছোটখাটো অপরাধেও জড়িয়ে পড়েছেন। গভীর অন্ধকারে তলিয়ে গেছেন। তবে মিলখা-সিংয়ের অদম্য লড়াই তাঁকে ব্যর্থতার অন্ধকার থেকে আলোয় নিয়ে আসে। রাস্তার রেস্তোরাঁর বয় থেকে ভারতীয় আর্মিতে, তারপর ভারতের সর্বকালের সেরা ক্রীড়াবিদ হয়েছেন। সবই যেন সিনেমা।
ভারতীয় সেনাবাহিনীতে চাকরির চেষ্টা করেছিলেন, তবে কিছুতেই কিছু হচ্ছিল না। একের পর এক ব্যর্থ হচ্ছিলেন। তবে ব্যর্থতার পর যেভাবে সফলতা আসে, মিলখার জীবনেও সেভাবেই এসেছিল সফলতা। সাফল্যের প্রথম সিড়ি, ভারতীয় আর্মিতে সুযোগ পাওয়া। ১৯৫১ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে সুযোগ পান মিলখা, সবমিলিয়ে চতুর্থবারের চেষ্টায়। তখনও সত্যিকারের অ্যাথলেটিক্সের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটেনি, সেকেন্দ্রাবাদে থাকাকালীন প্রথমবার অ্যাথলেটিক্সের কোর্টে নামেন মিলখা।
সেনাবাহিনীতে থাকাকালীন তার একজন অ্যাথলেটিক্স কোচের সাথে পরিচয় হয়।মিলখা-সিং খুব ভাল দৌড়েতে পারতেন বলে তাকে সেনাবাহিনীর অ্যাথলেটিক্সের বিশেষ প্রশিক্ষণের জন্য তাকে নির্বাচিত করা হয়।
মিলখা-সিং স্বীকার করেছিলেন যে কীভাবে সেনাবাহিনী তাকে খেলাধুলায় সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে, এই বলে যে “আমি প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে এসেছি, দৌড় কী, বা অলিম্পিকের কিছুই জানতাম না”।
মিলখা-সিং এশীয় ও কমনওয়েলথ গেমসে ৪০০ মিটারে সোনা জয়ের একমাত্র ক্রীড়াবিদ। তিনি ১৯৫৮ এবং ১৯৬২ এশিয়ান গেমসেও স্বর্ণপদকও জিতেছিলেন। মেলবোর্নে ১৯৫৬ গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক, রোমের ১৯৬০ সালের গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক এবং টোকিওতে ১৯৬৪ গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন।
১৯৫৮ সালে মিলখা-সিং পাকিস্তানের স্প্রিন্টার আবদুল খালিককে ২০০ মিটার দৌড়ে হারিয়ে টোকিও এশিয়ান গেমসে স্বর্ণপদক জিতেছিলেন। এর আগে আবদুল খালিক এশিয়ার দ্রুততম স্প্রিন্টার ছিলেন।
মিলখা সিং [ Milkha Singh ] আবদুল খালিক কে পরাজিত করার পরে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল আয়ুব খান তাঁকে “দ্য ফ্লাইং শিখ” উপাধি দিয়েছিলেন। নিঃসন্দেহে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপ্রধানের কাছ থেকে ভারতীয় কোন ক্রীড়াবিদের এমন উপাধি পাওয়া বিশেষ কিছু৷
সে বছরেই রোম অলিম্পিকের সামান্য আগে ফ্রান্সে ৪০০ মিটার রেসে ৪৫.৮ সেকেন্ডের বিশ্ব রেকর্ড গড়েছিলেন।
তিনি ১৯৫৬ মেলবোর্ন অলিম্পিক গেমসের ২০০ মিটার এবং ৪০০ মিটার প্রতিযোগিতায় ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। সেবার তিনি সাফল্য পাননি তার অনভিজ্ঞতার কারনে।
১৯৫৮ সালে,মিলখা-সিং [ Milkha-Singh ] বর্তমান উড়িষ্যার কটকে অনুষ্ঠিত ভারতের জাতীয় গেমসে ২০০ মিটার এবং ৪০০ মিটার দৌড়ে রেকর্ড তৈরি করেছিলেন এবং এশিয়ান গেমসে একই ইভেন্টে স্বর্ণপদকও জিতেছিলেন। তারপরে ১৯৫৮ সালের কমনওয়েলথ গেমসে ৪৬.৬ সেকেন্ড সময় নিয়ে তিনি ৪০০ মিটার প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক জিতেছিলেন। মিলখা সিং ই একমাত্র ভারতীয় পুরুষ যিনি এই গেমসে এককভাবে অ্যাথলেটিক্স স্বর্ণপদক জিতেছিলেন।
জাকার্তায় অনুষ্ঠিত ১৯৬২ সালের এশিয়ান গেমসে সিং ৪০০ মিটার এবং 4 x 400 মি রিলে সোনা জিতেছিলেন। তিনি টোকিওর ১৯৬৪ সালের অলিম্পিক গেমসে অংশ নিয়েছিলেন, যেখানে তিনি 400 মিটার, 4 x 100 মি রিলে এবং 4 x 400 মি রিলে প্রতিযোগিতা করতে প্রবেশ করেছিলেন। তিনি 400 মিটার বা 4 x 100 মিটার রিলে কোনও অংশ নেননি।
ধারণা হয় যে রয়েছে যে সিং তার ৮০ টি দৌড়ের মধ্যে ৭৭ টিতেই জিতেছিলেন।
মিলখা সিং ট্র্যাকের একজন এমন চ্যাম্পিয়ন, এমন একজন বিজয়ী যার কোনও পরিচয় প্রয়োজন নেই। তাঁর কথায়, কঠোর পরিশ্রম ইচ্ছা শক্তি এবং উত্সর্গতা তাকে চ্যাম্পিয়ন হতে সহায়তা করেছিল। এমনকি ট্র্যাকের বাইরেও মিলখা হ’ল মানব চেতনার সক্ষমতা। এবং এই কারণে, তিনি চিরকালের জন্য কেবল ক্রীড়াবিদ নয়, পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের জন্য অনুপ্রেরণা হিসাবে থাকবে। ২০২১ সালের ২১ শে জুন কোভিড আক্রান্ত হয়ে মারা যান মিলখা সিং।
[ মিলখা সিং, দ্যা ফ্লায়িং শিখ ]
আরও পাড়ুন: