রোনালদিনহো গাউচো, নামটি কখনো শুনেননি এমন কোনো ফুটবল বোদ্ধাকে বোধ হয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। রোনালদিনহো নিজের দিনে ফুটবলীয় সৌন্দর্যের মাধ্যমে দর্শকদের দিয়েছিলেন শৈল্পিক ফুটবল উপভোগের আনন্দ। নিজের পায়ের যাদুতে একটা সময় পুরো বিশ্বকে মোহিত করে রেখেছিলেন রোনালদিনহো গাউচো।
১৯৮০ সালে ব্রাজিলের পোর্তো আলেগ্রি শহরে জন্ম নেয়া এই ফুটবলারের ফুটবল প্রতিভার দেখা মেলে ছোট বেলায়ই। ব্রাজিলের গ্রেমিও থেকে ২০০১ সালে প্যারিস-সেইন্ট-জার্মেই, সেখান থেকে ২০০২-০৩ মৌসুমে আসেন বার্সেলোনায়। মূলত বার্সায় এসেই যেন নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে শুরু করেন এই তারকা। ২০০২ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের শিরোপা জেতার দলের অন্যতম খেলোয়াড় ছিলেন এই ব্রাজিলিয়ান তারকা।

[ রোনালদিনহো গাউচোঃ ফুটবল পায়ে ম্যাজিক দেখানো এক যাদুকর ]
ফুটবল যে শুধু খেলা না, শিল্পও- নিজের দু’পায়ের জাদুতে ফুটবল বিশ্বকে বুঝিয়ে দিয়েছেন এই তারকা। শিল্পের কারুকার্য প্রদর্শনের মাধ্যমে ২০০৪ ও ২০০৫ সালে ফিফা বর্ষসেরা পুরস্কার নিজের ঝুলিতে যোগ করেছেন, নিজের ক্লাব বার্সেলোনাকে এনে দিয়েছেন লা লিগা শিরোপা। ক্লাবটির হয়ে করেন ৭০ গোল। ২০০৫ সালে জিতেছেন ব্যালন ডি’অর।
২০০৮ সালে বার্সেলোনার ছায়া থেকে বের হয়ে যোগ দেন এসি মিলানে। ইতালিয়াল ক্লাবটির হয়ে সিরি ‘আ’ শিরোপাও জেতেন। এরপরই মূলত রোনদিনহোর ক্যারিয়ার পড়তির দিকে যেতে থাকে। এসি মিলানের পর ফ্লেমেঙ্গো, অ্যাথলেটিকো মিনেইরো, কোয়েরেতারো ও ফ্লুমিনেন্স ক্লাবের হয়ে বেশকিছু দিন তবে কোথাও থিতু হতে পারেননি।

নিজের ক্যারিয়ারের পড়তির এক সময়ে হুট করে পেশাদার ফুটবল থেকে বিদায় নেন ফুটবলের এই শিল্পী। অবশ্য তার জন্য রোনালদিনহোর অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন কোন অংশে কম দায়ী নন। অবশ্য অ্যাথলেটিকো মিনেইরোকে দক্ষিণ আমেরিকার ক্লাব ফুটবলের সবচেয়ে বড় খেতাব কোপা লিবর্তাদোরেস জিতিয়েছেন ২০১৩ সালে।
অনেকে তার সম্পর্কে বলেন , নিজের ক্যালিবারের তুলনায় ক্যারিয়ারে প্রাপ্তিটা রোনালদিনহোর একটু কমই। ২০০৫ সালে স্পোর্টস জায়ান্ট নাইকি রোনালদিনহোকে নিয়ে একটি বিজ্ঞাপন ভিডিও নির্মাণ করেন। যেখানে দিনহো বল মাটিতে ছুঁতে না দিয়ে চার বার ক্রসবারটি ধাক্কা মারার আগে একটি নতুন জুতা ব্যবহার করার চেষ্টা করেন। অবাক হলেও সত্য, ইউটিউবে প্রথম এক মিলিয়ন ভিউপ্রাপ্ত এটিই। ভিডিওটির সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও রোনালদিনহোর স্কিল সম্পর্কে কারও দ্বিমত নেই। ২০১৫ সালে এই ভিডিওর দশ বছর পূর্তি উপলক্ষে ‘গোল্ডেন টামে’ ভিডিওটির নতুন সংস্করণ বের করে তার সত্যতা প্রমাণ করে।

সাধারণত, ধনী অ্যাথলেটদের জন্য অভিনব গাড়ি চালানো মোটেও অস্বাভাবিক কিছু নয়, তবে একসময় রোনালদিনহোর বিলাসবহুল জীবন যেন সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এক সময় রোনালদিনহোর সংগ্রহে বিলাসবহুল সব গাড়ি ছিল। তার সংগ্রহে থাকা গাড়িগুলোর মধ্যে একটি অডি কিউ ৭, একটি হামার ২ এবং একটি ১.৩ মিলিয়ন ডলার বুগাটি ভায়রন রয়েছে, যার পরেরটি প্রতি ঘন্টা ২৫৩ মাইল গতিবেগ, একটি ডাব্লু ১৬ ইঞ্জিন এবং ১০০১ অশ্বশক্তি সহ বিশ্বের দ্রুততম গাড়িগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল।
২০০৪ সালে রোনালদিনহোর জাদুতে রিয়াল মাদ্রিদকে নিজেদের মাঠে বিধ্বস্ত করে বার্সেলোনা। সেবার দারুণ একটি গোল করে দিয়েগো ম্যারাডোনা পর বার্সেলোনার প্রথম ফুটবলার হিসেবে রিয়ালের মাঠ বার্নাব্যুতে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের স্ট্যান্ডিং অভিয়েশন পান। ম্যাচটি বার্সেলোনা জিতেছিল ৩-০ গোলে।
বার্সেলোনায় থাকাকালীন সময়ে রোনালদিনহো গাউচো ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবগুলো থেকে প্রচুর প্রস্তাব পান। তবে বার্সা প্রেসিডেন্টের প্ররোচনায় প্রতিবারই তা প্রত্যাখ্যান করেন ব্রাজিলিয়ান তারকা। ২০১৩ সালে প্রিমিয়ার লিগের পয়েন্ট টেবিলের শীর্ষে থাকা লেস্টার সিটিও রোনালদিনহোকে দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করে। বার্সা তারকা সেই প্রস্তাবও প্রত্যাখ্যান করেন।

যদিও সাম্প্রতিক সময়ে স্প্যানিশ পত্রিকা মুন্ডো দেপার্তিভো এক প্রতিবেদনে দাবি করেন, মূলত চীন থেকে বড় ধরবের প্রস্তাব আসবে এই প্রত্যাশায় সেবার রোনালদিনহো ফক্সদের না করে দেন। কোকা কোলার চুক্তিবদ্ধ ফুটবলার হয়েও সংবাদ সম্মেলনে পেপসির পানি খাওয়ায় রোনালদিনহো কোকা-কোলার সাথে একটি লাভজনক $৭৫০,০০০ স্পনসরশিপ চুক্তি হারিয়েছিলেন।
২০১৪ বিশ্বকাপে উপলক্ষ্যে নিজেদের পণ্যের প্রচারের জন্য কোকা-কোলা রোনালদিনহোর সঙ্গে চুক্তিটি করেছিল। তবে চুক্তি লঙ্ঘনের কারণে স্বাক্ষর হওয়ার এক বছরেরও কম সময় পরে এটি বাতিল করা হয়। পরে জানা যায়, এখানে রোনালদিনহোর কোন দোষ ছিল না; রোনালদিনহোর ক্লাব অ্যাথলেটিকো মিনেইরার পরিচালক ইচ্ছে করে এই কাজ করেছিলেন।
ডেভিড বেকহ্যাম, ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো এবং অন্য ফুটবলারদের মত রোনালদিনহো গাউচো নিজের নামে একটি ব্রান্ড তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন। ‘ফ্রি সেক্স’ নামে একটি পণ্যের প্রচারও শুরু করেছিলেন। কিন্তু, ক্লাব প্রেসিডেন্টের অসহযোগিতায় পরে তা আর সফল হয়নি। যুগে যুগে ফুটবল ইতিহাসে অনেক কীর্তিমান খেলোয়াড় জন্ম নিয়েছে। অনেকে অনেক কীর্তি রেকর্ড তৈরী করেছেন।
কিন্তু, ফুটবল ইতিহাসে মাত্র কয়েকজন খেলোয়াড় নিজেদের স্টাইলে স্বতন্ত্র একটি ধারাবাহিকতা সৃষ্টি করেছেন, জাদুকর রোনালদিনহো তাদের একজন। রোনালদিনহো গাউচো ছিলেন এমন একজন খেলোয়াড় যাকে প্রতিপক্ষ দলের সমর্থকরাও ঘৃণা করার সাহস পেত না। ফুটবল মাঠে নিরেট এই ভদ্রলোকের হেটার্স খুঁজে পাওয়াও দুস্কর! তিনি ছিলেন একজন পার্ফেক্ট ম্যাজিশিয়ান।
আরও পড়ুন:
- ওয়েলসের ৬৪ বছর পর বিশ্বকাপে পদার্পণ
- মরিনহোর স্পেশাল ওয়ান হয়ে ওঠা
- মার্সেলোর অশ্রুশিক্ত বিদায়
- হ্যালান্ডের কাছে গোল করা খুব সহজ !
- রিকুয়েলমে; কোচের প্রভাবে যার ফুটবল ক্যারিয়ারের বলি!
- ফুটবল বিশ্বকাপ ১৯৫০, কেন খেলেনি ভারত?
- ফুটবল বিশ্বকাপে মাঠের মজার ঘটনা
- ফুটবল বিশ্বকাপের শুরু যেভাবে [ The way the football world cup started ]
- ফুটবলের যত কুসংস্কার [ The superstition in Football ]
- স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল : ফুটবল দিয়েই মুক্তিযুদ্ধ [ Shadhin Bangla Football Team, 1971]
- ফুটবল বিশ্বে স্বপ্নপূরণ এবং স্বপ্নভঙ্গের এক সপ্তাহ
- ফুটবল বিশ্বে প্রতিনিয়ত বাড়ছে মুসলিমদের প্রতি সম্মান
- বৃষ্টির দিনের মন মাতানো ফুটবল
- ফুটবলকে বিদায় জানালেন কার্লোস তেভেজ
- রোনালদিনহো গাউচোঃ ফুটবল পায়ে ম্যাজিক দেখানো এক যাদুকর
“রোনালদিনহো গাউচোঃ ফুটবল পায়ে ম্যাজিক দেখানো এক যাদুকর”-এ 5-টি মন্তব্য