লিওনেল মেসির মেসি হয়ে উঠা

লিওনেল মেসির মেসি হয়ে উঠা : মেসি মানেই শৈল্পিক ফুটবলের রাজা, মেসি মানেই প্রতিপক্ষকে নাস্তানাবুদ করে রাখা এক ঝড়। মেসি মানেই অকল্পনীয় ফি কিকে গোল, মেসি মানেই অবিশ্বাস্য সব ফুটবল কৌশল, মেসি মানেই মেসি ম্যাজিক।

সর্বকালের সেরা ফুটবলার লিওনেল মেসি আর্জেন্টিনার রোজারিওতে স্টিল কারখানায় কর্মরত বাবা হোর্হে হোরাসিও মেসি এবং পার্ট-টাইম ক্লিনার মা সেলিয়া মারিয়া কুচ্চিত্তিনি এর ঘরে ১৯৮৭ সালের ২৪শে জুন জন্মগ্রহন করেন। মেসির  পৈতৃক পরিবারের আদি বাসস্থান ছিল ইতালির আকোনা শহরে।

মেসির পূর্বপুরুষদের একজন অ্যাঞ্জেলো মেসি ১৮৮৩ সালে সেখান থেকে আর্জেন্টিনায় চলে আসেন।
মেসির মেসি হয়ে উঠা
শিশু মেসি
মেসির বড় দুই ভাই এবং এক ছোট বোন রয়েছেন।  বড় দুই ভাইয়ের নাম রদ্রিগো ও মাতিয়াস এবং ছোট বোনের নাম মারিয়া সল। পাঁচ বছর বয়সে মেসি স্থানীয় ক্লাব গ্রান্দোলির হয়ে ফুটবল খেলা শুরু করেন যার কোচ ছিলেন তার বাবা হোর্হে।
১৯৯৫ সালে মেসি রোজারিও ভিত্তিক ক্লাব নিওয়েল’স ওল্ড বয়েজে যোগ দেন। একই সময় মেসি একটি স্থানীয় যুব শক্তিক্লাবের সদস্য হয়ে পড়েছিল যার ফলে এই ক্লাবটি পরবর্তী চার বছরে একটি মাত্র খেলায় পরাজিত হয়েছিল এবং স্থানীয়ভাবে মেসি “দ্য মেশিন অফ ‘৮৭” নামে পরিচিত হয়ে উঠেছিল। তাকে “দ্য মেশিন অফ ‘৮৭”  নামে ডাকার কারণটাও মজার। কারণ সেই সময় পরিচিত হয়ে ওঠা সবাইকেই তাদের জন্মসাল (১৯৮৭) সহ নাম দেয়া হত।
মেসির ছোট বেলা থেকেই ধ্যানজ্ঞান ছিল ফুটবল যার যার ফলে খুব সহজেই স্থানীয়ভাবে পরিচিতি পায় কিন্তু মাত্র ১১ বছর বয়সে মেসির গ্রোথ হরমোনের সমস্যা ধরা পড়ে। স্থানীয় ক্লাব রিভার প্লেট মেসির প্রতি তাদের আগ্রহ দেখালেও সেসময় তারা মেসির চিকিত্সার খরচ বহন করা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিলনা। যার পরিমাণ ছিল প্রতি মাসে ৯০০ মার্কিন ডলার। যার ফলে মেসির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। যখন মেসির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত ঠিক ওই সময় বার্সেলোনার তত্কালীন ক্রীড়া পরিচালক কার্লেস রেক্সাচ মেসির পাশে এসে দাড়ায় কারণ মেসির প্রতিভা সম্পর্কে জানতে পেরে তিনি মেসির খেলা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন।
মেসির সাথে চুক্তির সময় হাতের কাছে কোন কাগজ না পেয়ে একটি ন্যাপকিন পেপারে তিনি মেসির বাবার সাথে চুক্তি সাক্ষর করেন। বার্সেলোনা মেসির চিকিত্সার সমস্ত ব্যয়ভার বহন করতে রাজী হয়। এরপর মেসি এবং তার বাবা বার্সেলোনায় পাড়ি জমান। সেখানে মেসি বার্সেলোনার যুব একাডেমী লা মাসিয়াতে যোগ দিয়ে নতুন উদ্দীপনায় আবার তার খেলোয়াড় জীবন শুরু করে।
Sports Gurukul GOLN Website Logo 01 লিওনেল মেসির মেসি হয়ে উঠা
মেসি ২০০০ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত বার্সেলোনার যুব একাডেমীর ইনফান্তিল বি, কাদেতে বি এবং কাদেতে এ দলে খেলেছেন। কাদেতে এ দলে খেলার সময় তিনি ৩০ খেলায় ৩৭ গোল করেন। ২০০৩ সালে অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার কারণে তাকে ক্লাব থেকে প্রায় ছেড়েই দেওয়া হয়েছিল কিন্তু যুব দলের প্রশিক্ষণ কর্মীদের জোড়াজুড়িতে ক্লাবের ব্যবস্থাপনা পরিষদ তাকে দলে রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
২০০৩–০৪ মৌসুমে মেসি পাঁচটি আলাদা দলে খেলেন, যা একটি রেকর্ড। তিনি হুভেনিল বি দলে খেলে ১টি গোল করেন এবং হুভেনিল এ দলে খেলার সুযোগ লাভ করেন। সেখানে তিনি ১৪ খেলায় ২১টি গোল করেন। ২০০৩ সালের ২৯ নভেম্বর, বার্সেলোনা সি (তের্সেরা দিভিসিওন) দলে এবং ২০০৪ সালের ৬ মার্চ, বার্সেলোনা বি (সেহুন্দা দিভিসিওন) দলে তার অভিষেক হয়।
ঐ মৌসুমে তিনি উভয় দলের হয়েই খেলেন এবং সি দলের হয়ে তার গোল সংখ্যা ছিল ১০ খেলায় ৫ এবং বি দলের হয়ে ৫ খেলায় শূন্য। এই দুই দলে অভিষেকের পূর্বে মেসির দাপ্তরিক অভিষেক হয়েছিল ২০০৩ সালের ১৬ নভেম্বর, পোর্তোর বিপক্ষে একটি প্রীতি খেলায় (১৬ বছর এবং ১৪৫ দিন বয়সে)।
২০০৪ সালের ১৬ অক্টোবর, ইস্পানিওলের বিপক্ষে বার্সেলোনার তৃতীয় কনিষ্ঠতম খেলোয়াড় হিসেবে মেসির লা লিগায় অভিষেক হয় (১৭ বছর এবং ১১৪ দিন বয়সে)। অবশ্য, ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে, বোয়ান কিরকিচ এই স্থান দখল করেন।
২০০৫ সালের ১ মে, আলবাকেতে বালোম্পাইয়ের বিপক্ষে বার্সেলোনার সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে লা লিগায় গোল করার রেকর্ড গড়েন মেসি (১৭ বছর ১০ মাস এবং ৭ দিন বয়সে)। অবশ্য তার এই রেকর্ড ২০০৭ সালে বোয়ান কিরকিচ ভেঙ্গে ফেলেন। ২০০৫ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয়বারের মত বার্সেলোনা মেসির সাথে তাদের চুক্তি নবায়ন করে।
এসময় মূল দলের খেলোয়াড় হিসেবে মেসির পারিশ্রমিক বাড়ানো হয় এবং চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১৪ সাল পর্যন্ত করা হয়। ২০০৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর, মেসিকে স্পেনের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয় এবং তিনি লা লিগায় খেলার সুযোগ পেয়ে যান। এরপর, মেসিকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। নিজের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে একের পর এক ছুয়েছেন মাইলফলক ছুয়েছেন দ্যা ম্যাজিশিয়ান।
মেসির মেসি হয়ে উঠা
বার্সেলোনার জার্সিতে মেসি
মেসি ২০০৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর বার্সেলোনার সাথে ২০১৬ সাল পর্যন্ত নতুন করে চুক্তিবদ্ধ হন। এই চুক্তির সময় মেসির মূল্য রাখা হয় ২৫০ মিলিয়ন ইউরো এবং এই চুক্তির মাধ্যমে মেসির বার্ষিক আয় বেড়ে দাড়ায় ৯.৫ মিলিয়ন ইউরো। একই বছর ১ ডিসেম্বর ব্যালন ডি’অর বিজয়ী হিসেবে মেসির নাম ঘোষনা করা হয়।
মেসির মেসি হয়ে উঠা
প্রথমবার ব্যালন ডি’অর জেতার পর মেসি
এবারের ব্যালন ডি’অর পুরষ্কারে মেসি ৪৭৩ পয়েন্ট নিয়ে প্রথম এবং ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো ২৩৩ পয়েন্ট নিয়ে দ্বিতীয় হন। এটি ছিল ব্যালন ডি’অর এর ইতিহাসে সর্বোচ্চ ব্যবধানে জয়ের রেকর্ড। একই সময় মেসি আইএফএফএইচএস বর্ষসেরা প্লেমেকার পুরস্কারে দ্বিতীয় হন। বর্তমান, সময়ে বিশ্বের অন্যতম ধনী ক্লাব পিএসজিতে খেলছেন মেসি। ২০২১ সালে কোপা আমেরিকার শিরোপাও জিতেছেন আর্জেন্টিনার হয়ে। এখন দেখার বিষয়, ২০২২ বিশ্বকাপেও নিজের দলকে চ্যাম্পিয়ন করতে পারেন কিনা।
পেশাদারিত্ব, ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা, ১১০ নম্বর দলের বিরুদ্ধেও নিজেকে প্রমাণ করার তাগিদ, তাঁর খিদে- সকলের থেকে আলাদা করে দেয় লিওনেল মেসিকে। না হলে এস্তোনিয়ার মতো ১১০ নম্বর দলের বিরুদ্ধেও তিনি মাঠে নামেন! বাকি সিনিয়র প্লেয়াররা যখন বিশ্রামে, তখন মেসি সেই আগের অ্যাড্রিনালিন ঝরিয়ে মাঠে নেমে একেবারে ফুল ফোটালেন।
লিওনেল মেসি
এস্তোনিয়ার বিপক্ষে মেসি
একটা-আধটা নয়, একেবারে পাঁচে পাঁচ করে নয়া নজিরও গড়ে ফেললেন আর্জেন্টিনার তারকা।আর্জেন্টিনার অধিনায়ক লিওনেল মেসি প্রথম ফুটবলার, যিনি ইউরোপিয়ান কাপ বা উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খেলার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচেও পাঁচটি গোল করলেন। তিনি আর্জেন্টিনারও প্রথম প্লেয়ার, যিনি দেশের জার্সিতে এক ম্যাচে ৫ গোল করার নজির গড়ে লিখে ফেললেন ইতিহাস।
এ দিনের ম্যাচের পরে মেসি ব্রাজিলের কিংবদন্তি পেলেকে টপকে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর পরে ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছেন। মেসির এখন ক্লাব এবং দেশের হয়ে ৭৬৯টি গোল রয়েছে। যেখানে রোনাল্ডোর মোট গোলসংখ্যা ৮১৩। পেলে তাঁর বর্ণাঢ্য কেরিয়ারে ৭৬৭টি গোল করেছিলেন।

Leave a Comment