হকির ইতিহাস এবং বাংলাদেশে হকি

হকির ইতিহাস এবং বাংলাদেশে হকি : হকি একটি আন্তর্জাতিক খেলা, যা খেলা হতো বহু আগে থেকেই৷ বল এবং লাঠি ব্যবহৃত খেলাগুলোর মধ্যে হকিকেই সবচেয়ে প্রাচীন বলে মনে করা হয়। প্রায় ৫০০০ বছর পূর্বে প্রাচীন গ্রীসে এ খেলার জন্ম হয় বলে ধারণা করা হয়।তবে তখন এটিকে হকি বলা হতো না, বরং বলা হতো লাঠি খেলা। এছাড়া, মিসর এবং ইউরোপসহ বেশ কয়েকটি স্থানে হকি খেলা সম্বলিত প্রমাণ পাওয়া যায়। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন নামে ডাকা খেলা হকির নিয়মকানুন আজকের নিয়মকানুন থেকে অনেক আলাদা ছিলো।

হকির ইতিহাস এবং বাংলাদেশে হকি : বাংলাদেশ হকি ফেডারেশন লোগো
বাংলাদেশ হকি ফেডারেশন

১৭ এবং ১৮ শতকে ইংল্যান্ডে প্রচুরভাবে খেলা হকিতে মোট ১০০ জন করে অংশ নিতো প্রতিটি দলে, যেটি প্রচুর বিশৃঙ্খলা জন্ম দিতো এবং তখনকার সময়ে এক একটি খেলা ১৫ থেকে ২০ দিন পর্যন্ত চলতো। খেলাটিতে শৃংখলা আনয়নের লক্ষ্যে ১৮৭৫ সালে ইংল্যান্ডে প্রতিষ্ঠিত হয় দ্য হকি অ্যাসোসিয়েশন যা গ্রীসে উৎপত্তিত হকি খেলাটিকে পূর্ণতা দান করে। ১৮৯৫ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক হকি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয় যেটিতে আয়ারল্যান্ডকে ৫-০ গোলে হারায় ইংল্যান্ড। এরপর,7 ১৯০৮ সালে অলিম্পিকে অন্তর্ভুক্ত হয় হকি এবং ১৯৪২ সালে গঠিত হিয় ফেডারেশন ইন্টারন্যাশনাল দ্যা হকি যা হকির সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা।

 

১৯৭১ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম পুরুষ বিশ্বকাপ হকিতে অংশগ্রহণ করে পাকিস্তান, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, হল্যান্ড, ইংল্যান্ড, কোরিয়া, মালয়েশিয়া প্রভৃতির মতো ১৬ টি দেশ যেখানে চ্যাম্পিয়ন হয় পাকিস্তান।এর ৪ বছর পর ১৯৭৫ হকি বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন তাদেরই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারত যেটি এখন পর্যন্ত তাদের একমাত্র হকি বিশ্বকাপ শিরোপা। এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপ হকির সবকটি আসরের মধ্যে সব থেকে বেশী ৪ বার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছ পাকিস্তান।এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পাকিস্তান ছাড়া শুধু ভারতই বিশ্বকাপ হকির শিরোপা ঘরে তুলতে পেরেছে।

বাংলাদেশে হকি খেলা ব্রিটিশ আমলেই শুরু হয়েছে। এরপর অবশ্য ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতন ঘটলে এদেশে হকির বিস্তার তেমন একটা হচ্ছিল না। তবে, পাকিস্তান শাসনামলে বেশ কিছু হকি টুর্ণামেন্টে অংশ নেয় পূর্ব পাকিস্তান হকি দল। এছাড়াও, ১৯৭১ হকি বিশ্বকাপে পাকিস্তান দলে দুই জন বাংলাদেশী ছিলো। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সর্বপ্রথম যদি কোনো আন্তর্জাতিক খেলা বাংলাদেশের মানুষদের মধ্যে আনন্দ এবং উত্তেজনার জোয়ার আনে, তা হলো হকি।

Women’s Hockey first appeared in the 1980 Olympics, in Moscow.
মেয়েদের প্রথম হকি, ১৯৮০ অলিম্পিক, মস্কো।

বাংলাদেশ হকিতে তাদের সবচেয়ে ভালো সময় কাটিয়েছে ১৯৮৫ সালে। জুম্মন লুসাই, সালাউদ্দিন তিশার মতো খেলোয়াড়েরা সে সময় বিশ্ব হকিতে চিনিয়েছে বাংলাদেশের নাম। জুম্মন লুসাই হলেন একমাত্র খেলোয়াড় যিনি বিশ্ব হকি একাদশে বাংলাদেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশে আয়োজিত এশিয়া কাপ হকি হতে পারত এদেশে হকির এক অন্যতম টার্ণিং পয়েন্ট। সে সময় বিশ্ব হকিতে সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী দল ছিলো ভারত এবং পাকিস্তান।

১৯৮৫ এশিয়া কাপ হকিতে বাংলাদেশের আক্রমণাত্মক হকি, নজড় কেড়েছিলো পুরো বিশ্বের। সেবার, ইরানকে হারিয়ে জাপান এবং চীনকেও রুখে দিয়েছিল লাল সবুজের বাংলাদেশ দল। সে টুর্নামেন্টে জাপান এবং চীনের বিপক্ষে শেষ মুহুর্তের নাটকীয় জয় তীব্রভাবে জাগিয়ে তুলেছিল বাংলাদেশে হকির জোয়ার। পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচের আগে চলছিল টিকেটের জন্য হাহাকার। পাকিস্তানের বিপক্ষে ড্র করলেই এশিয়া কাপ হকির সেমি ফাইনালে যেতে পারত বাংলাদেশ। পুরোটা ম্যাচ জুড়ে দাপট চালিয়ে খেলছিলোও তারা। কিন্তু, অতি আক্রমণাত্মক কৌশলই কাল হলো বাংলাদেশের জন্য। ম্যাচের শেষ দিকে, এক কাউন্টার অ্যাটাকে গোল খেয়ে শেষ মুহুর্তে সেমিফাইনালে খেলার স্বপ্নভঙ্গ হয় বাংলাদেশের। একটুর জন্য সেমি ফাইনালে খেলতে ব্যার্থ বাংলাদেশ হল পুরো টুর্নামেন্টেই দেখিয়েছিল রাজকীয় প্রতাপ।

 

সে সময়ের বিশ্বসেরা পাকিস্তানের সাথে এভাবে চোখে চোখ মিলিয়ে লড়াই করা বাংলাদেশ দল গোটা দেশেই এক পুনর্জাগরণ করেছিল হকির। যার কারণে দেশের সর্বস্ততরে ছড়িয়ে পরে হকি। গ্রাম গঞ্জ, শহর, নদী, পুকুর সব জায়াগাতেই। তবে হকির এ জোয়ার বেশি দিন টিকে থাকেনি বাংলার মাটিতে। নানারূপ অব্যবস্থাপনাই ধসিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের হকিকে। বর্তমান পাওয়ার হকির যুগের সাথে তাল মিলিয়ে না চলাও এবং হকি কর্তাদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ কোন্দল বাংলাদেশে হকির প্রসারকে দিনের পর দিন আরো নিম্নগামি করছে।

Dhyan Chand (standing second from left) with the Indian hockey team at the 1936 Berlin Olympics. Photo- Olympic Archives.
ভারতের হকি টিম, ১৯৩৬ সালের অলিম্পক, বার্লিন।

ক্রিকেট এবং ফুটবলেরও তুলনায় ব্যয়বহুল খেলা হকি এখন মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তদের নাগালের বাহিরে। ৮০ এর দশক থেকে বাংলাদেশে হকির অ্যাস্ট্রোটার্ফ আনার জোড়ালো সুর উঠছিল। কিন্তু, হকির এক অশুভ শক্তি তা হতে দেয়নি বরং পিছিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের হকি। বাংলাদেশ, হকির অ্যাস্ট্রোটার্ফ যুগে প্রবেশ করে ২০০০ সালেরও পরে। যেখানে, বিশ্বহকিতে প্রতিষ্ঠিত দলগুলোর মধ্য সবগুলোই অ্যাস্ট্রোটার্ফে খেলছিলো সেখানে বাংলাদেশ।

অ্যাস্ট্রোটার্ফে খেলার সুযোগ পায় তাদের থেকে ২০ বছরেরও বেশি সময় পরে।আন্তর্জাতিক হকিতে বাংলাদেশের অর্জন তেমন একটা নেই বললেই চলে। এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক হকিতে বাংলাদেশ কোনো শিরোপা জয়ের স্বাদ নিতে পারেনি। তবে ১৯৯৫,২০১০ এবং ২০১৬ দক্ষিণ এশিয়া গেমসে ব্রোঞ্জ জয় বাংলাদেশ হকির এক অন্যতম অর্জন। এখন পর্যন্ত এফআইএইচ হকি র‍্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের সেরা অবস্থান যা ২০০৩-০৪ এবং ২০০৬-০৭ এর সময়ে ছিলো। পূর্বে ওমান এবং সিংগাপুরের মতো দলের কাছে হেসে খেলে জিতলেও বর্তমানে তাদের বিপক্ষে জয়ও এক কষ্টসাধ্য ব্যাপার। ২০১৭ সালে ঢাকায় এশিয়া কাপ হকির আসরে শক্তিশালী চীনকে হারায় বাংলাদেশ।বর্তমানে এফআইএইচ র‍্যাংকিং অনুযায়ী বাংলাদেশ দলের অবস্থান ৩৮।

[ হকির ইতিহাস এবং বাংলাদেশে হকি ]

আরও পড়ুন:

 

Leave a Comment