রিকুয়েলমে; কোচের প্রভাবে যার ফুটবল ক্যারিয়ারের বলি!

কোচের প্রভাবে যার ফুটবল ক্যারিয়ারের বলি :  ১৯৮৬ সালে একা হাতে বিশ্বকাপ জেতান দিয়েগো ম্যারাদোনা, এক বছর বাদে পৃথিবীতে আগমন লিওনেল মেসির। ২০২০ সালে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে যান ম্যারাদোনা, পরের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে মেসি জেতেন ক্যারিয়ারের প্রথম আন্তর্জাতিক শিরোপা। ব্রাজিলকে ১-০ গোলে হারিয়ে জিতলেন কোপা আমেরিকার শিরোপার। সেটাও একা হাতেই বলা যায়! গোল্ডেন বল, গোল্ডেন বুট সবই জিতেছেন আর্জেন্টাইন সুপারস্টার। কাকতলীয় ঠেকছে?

 

রিকুয়েলমে; কোচের প্রভাবে যার ফুটবল ক্যারিয়ারের বলি!
হুয়ান রোমান রিকেল্‌মে

কাকতলীয় লাগতেই পারে, তবে কাকতালের ঘটনা আরো আছে। যখন শুনবেন আর্জেন্টিনার প্রথম বিশ্বকাপজয়ের ঠিক আগেরদিন জন্মেছিলেন এমন একজন ফুটবলার, বিশ্লেষকরা বলেন যার ক্ষমতা ছিল একা হাতে বিশ্বকাপ জেতানোর। তিনি হুয়ান রোমান রিকুয়েলমে।

আলবিসেলেস্তেদের এত এত কিংবদন্তিদের ভিড়ে তাকে কিংবদন্তি হয়তো বলা যায় না, তবে সত্যিকারের ফুটবলপ্রেমীদের কাছে তিনি ঠিকই কিংবদন্তিতুল্য। অবাক করা আরেকটি ব্যাপার, রিকুয়েলমে আর মেসি দুজনেই জন্মেছেন একই তারিখে।

মেসির খেলা তো দেখেছেন? পায়ে যখন বল আসে যেন মনে হয় জন্ম জন্মান্তরের জন্য ফুটবল তার। যেন মনে হয় ফুটবলের জন্মই হয়েছে তার জন্য। বলের উপরে নিয়ন্ত্রণ দেখলে পাড়ার ফুটবলের কথা মনে পড়ে যেতে পারে। আচ্ছা পাড়ার মাঠে বৃষ্টিতে খেলার অভ্যাস আছে তো?

ছোটবেলার স্মৃতি মনে পড়ছে নাকি? যার বল তারই সবকিছুতে খবরদারী। দল ভাগ করা থেকে শুরু করে একদম শেষপর্যন্ত। বলটাও তার কাছেই বেশিক্ষণ থাকতে হবে। ফুটবল মাঠে মেসিও তাই। বল যেভাবে তার পায়ে আঠার মতো লেগে থাকে তাতে মনে হতেই পারে, বলটাই তার!

মেসির সঙ্গে খেলার ধরণে মিল নেই, তবে বল নিয়ন্ত্রণের গুণই ছিল আরেকজনের মাঝে, তিনি রিকুয়েলমে। শুধুই তার স্বদেশি নয়, তিনি ছিলেন স্বয়ং তার সতীর্থ। মেসির মতোই বল আঠার মতো লাগিয়ে রাখতে পারতেন। এছাড়া মাঝমাঠের নিয়ন্ত্রণও ছিল বলার মতো।

বর্তমান প্রজন্মের ফুটবলভক্তদের কাছে মাঝমাঠ মানেই জাভি-ইনিয়েস্তাদের ফুটবলশৈলী, তবে অনেক ফুটবল ভক্তের কাছে রিকুয়েলমে ছিলেন ফুটবলের বিশুদ্ধ শিল্পী। বল নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলেও নিজের ভাগ্যকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি এই মিডফিল্ডার।

রিকুয়েলমে

রিকুয়েলমের আদর্শ ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার সক্রেটিস। সক্রেটিসের কাছে ফুটবল একটা বিশুদ্ধ শিল্প। শুধুই ম্যাচজয় নয়, ফুটবল তার কাছে সৌন্দর্য্য। অর্থাৎ তার কাছে সুন্দর কিছু অর্জনে ম্যাচ জেতাই শেষ কথা নয়।

গোল করার থেকেও গোল বানানো কিংবা প্রতিপক্ষকে পায়ে পায়ে ঘোরানো। কখনো কখনো ডিফেন্স চেড়া পাস- এটাই তো ফুটবলের সৌন্দর্য্য। সেই সৌন্দর্য্যেরই পূজারী ছিলেন তিনি। যতদিন খেলেছেন সবাইকে বিমোহিত করেছেন।

মেসি-রিকুয়েলমে-ম্যারাদোনার কথা বলা হচ্ছিল, তিনজনই মিলে যাবেন একবিন্দুতে। ম্যারাদোনার অধীনে খেলেছিল আর্জেন্টিনা। আকাশি-সাদাদের কোচ হয়েই প্রথম কোপটা পড়ল তার উপর! কেড়ে নিলেন তার দশ নম্বর জার্সি, সেই থেকে আর্জেন্টিনার দশ নম্বর জার্সি মেসির গায়ে। অভিমানী রিকুয়েলমেও আর গায়ে জড়াননি আর্জেন্টিনার জার্সি।

আরেকটা জায়গায় তিনজনেরই মিল আছে, তিনজনই গায়ে জড়িয়েছেন বার্সেলোনার ১০ নম্বর জার্সি। নিসন্দেহে আর্জেন্টাইন ক্লাব বোকা জুনিয়র্সের সর্বকালের সেরা ফুটবলার রিকুয়েলমে। ১৯৯৬ সালে নগর প্রতিদ্বন্দ্বী রিভার প্লেটকে বোকা বানিয়ে তাকে দলে ভেড়ায় বোকা জুনিয়র্স। মেসি-ম্যারাদোনা, কারো সঙ্গেই খেলার ধরণে মিল ছিল না। যদিও তাকে বলা হত নতুন ম্যারাদোনা।

আর বোকার জার্সিতে রিকুয়েলমের অভিষেক হয়েছিল ম্যারাডোনার বদলি হিসেবে নেমেই। যদিও দুজনে একসাথে বোকার নীল জার্সিতে ম্যাচ খেলেছেন মাত্র একটি। তবে সেখানেই বোঝা গেছে কেন তাকে ম্যারাদোনার উত্তরসূরী দাবী করা হতো।

তাদের খেলা দেখে মনে হচ্ছিল দুজন ফুটবলার অনুশীলন করছেন, একবার বল ম্যারাদোনার কাছে যাচ্ছে, একবার সেটা পাচ্ছেন রিকুয়েলমে। প্রতিপক্ষের প্লেয়াররা তো পারছেনই না, নিজেদের খেলোয়াড়রাই রীতিমতো মুগ্ধ।

সুখের সময় নাকি বেশিদিন স্থায়ী হয় না, বোকা সমর্থকদের ম্যারাদোনা আর রিকয়েলমেকে একসঙ্গে খেলতে দেখার সুখও দ=বেশিদিন টেকেনি। কেননা। একসঙ্গে ওটাই ছিল তাদের প্রথম এবং শেষ ম্যাচ, এরপরে আর একসাথে নামতে পারেননি দু’জন। ওই ম্যাচের পরেই ড্রাগটেস্ট ফেল করেছিলেন ম্যারাদোনা।

[  রিকুয়েলমে; কোচের প্রভাবে যার ফুটবল ক্যারিয়ারের বলি! ]

শুধুই ম্যারাদোনা নন, রিকুয়েলমের ফুটবল ক্যারিয়ারে কোচদের ছিল মিশ্র অবদান। আর্জেন্টিনার অন্যতম বড় সম্পদ ‘ফুটবল’। সেই সম্পদের গাছ ডালপালা মেলে ছড়িয়ে পড়ে পুরো ইউরোপে। সেভাবেই রিকুয়েলমে বার্সেলোনার নজরে পড়েছিলেন।

১০ মিলিয়নের চুক্তিতে পা রাখলেন কাতালান শিবিরে। সেটা নিয়ে আছে আরো এক গল্প! আর্জেন্টিনায় মাফিয়াদের হাতে কিডন্যাপ হয়ে গেলেন তার ভাই। বিরাট মুক্তিপণের দাবি এল। কোনোমতে ভাইকে মুক্ত করার পরই তিনি বাধ্য হলেন নিজের ভিটে ছেড়ে ইউরোপে পাড়ি দিতে। যোগ দিলেন বার্সেলোনায়। ধারণা করা হয় কোনোমতেই বোকা ছাড়তে না চাওয়ায় তার ভাইকে কিডন্যাপ করিয়েছে বার্সা।

রিকুয়েলমের খেলায় গতি ছিল না কখনোই। বল পায়ে সবসময়ই আগে গ্যাপ খোঁজেন, সেই গ্যাপ ব্যবহার করে পাস বাড়ান। শত চেষ্টাতেও তাকে পালটে ফেলা যায়নি। কারো বিশেষত্ব পালটে ফেললে কী তার আসল খেলাটা থাকে? ধরাটা মূলত খেয়েছে বার্সেলোনা। বার্সার কোচ তখন নেদারল্যান্ডসের লুই ভ্যান গাল। ক্ল্যাসিক্যাল ‘নাম্বার টেন’ নয়, রিকুয়েলমেকে জোর করে খেলালেন উইঙ্গারে।gurukul1 রিকুয়েলমে; কোচের প্রভাবে যার ফুটবল ক্যারিয়ারের বলি!

ইউরোপের গতি তো রিকুয়েলমের সহ্য হয় না, অভিমানে জেদে গো ধরলেন। শুরু হলো ঝামেলা, প্লেয়িং টাইম পাচ্ছিলেন না। ইউরোপের ফুটবল তার কাছে মনে হচ্ছিল ক্যান্সার। এক কোচের কারণে হারাতে বসা রিকুয়েলমে আবার জেগে উঠলেন আরেক কোচের হাত ধরে। তিনি ম্যানুয়েল পেলেগ্রিনি।

পেলেগ্রিনি তখন ভিয়ারিয়ালের কোচ, তার দলে তখন মার্কাস সেনা, পাওলো সোরিন, দিয়েগো ফোরলানের, ফিগুয়েরার মতো প্লেয়ার। তাদের একটাই অভাব ছিল, একজন পারফেক্ট মিডফিল্ডারের অভাব। সেই অভাব পুরণ করতে এসেছিলেন রিকুয়েলমে, পুরণও করেছিলেন। দলকে লা-লিগায় তৃতীয় করলেন, চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমিতে তুললেন।

রিকুয়েলমের ক্যারিয়ারে কোচের ইমপ্যাক্ট ছিল আরো, ২০০৬ বিশ্বকাপে। হোসে পেকারম্যান তখন আর্জেন্টিনার কোচ। তথাকথিত ‘মন্থর’ রিকুয়েলমকে নিয়েই তিনি সাঁজালেন তার রণকৌশল। পুরো টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত খেললেন তিনি, পেকারম্যানের প্ল্যানে। বিশ্বকাপ চলাকালীন তাঁকে দেওয়া হল ‘পেকারম্যানের ছেলে’ উপাধী।

কিন্তু সব কথার বাণের জবাব রিকুয়েলমে দিচ্ছিলেন ফুটবল পায়ে। সেই বিশ্বকাপের সর্বাধিক অ্যাসিস্টে যে তার নাম। আর্জেন্টিনার ফুটবলকে বাংলাদেশের ক্রিকেটের সঙ্গেও তুলনা করা যায়, মিওডিয়া এখানে অনেক বড় প্রভাব ফেলে। আর্জেন্টিনার ক্ষেত্রেও তাই।

জার্মানির বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে এই পেকেরম্যানই নিজের সন্তানতূল্য রিকুয়েলমেকে তুলে নিলেন মাঠ থেকে। ১-০ তে এগিয়ে থাকা আর্জেন্টিনা ছন্দ হারিয়ে শেষমেশ হেরেই বসে। একজন ফুটবলারের জীবনে কোচের প্রভাব এর থেকেও বেশি কেউ পেয়েছে?

আরও পড়ুন : 

 

Leave a Comment