মোমেন মুন্না [ Monem Munna ] হারিয়ে যাওয়া নায়ক !

মোমেন মুন্না তুমি বেঁচে থাকবে বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে…। হালের ক্রেজ৷ বর্তমান সময়ে এই উপমা দিয়ে যদি কোন ক্রীড়াবিদকে ব্যাখ্যা করতে বলা হয় তাহলে সংক্ষিপ্ত লিস্টের পুরোটা জুড়েই থাকবেন ক্রিকেটাররা৷ মাশরাফী বিন মোর্তজা, সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবাল, তাসকিন আহমেদ,সৌম্য সরকার- নামগুলো এভাবেই সাজানো হবে৷ কিন্তু, বর্তমান প্রজন্মের কারো কাছে যদি বলা হয় কোন ফুটবলারের প্রেমে একসময় মোহিত হত সমসাময়িক তরুণীরা,বিজ্ঞাপনদাতারা একজন ফুটবলারের পেছনে অর্থ বিনিয়োগ করতেন, ৯০ দশকে একজন ফুটবলার জনপ্রিয়তার দিক থেকে অভিনেতা-গায়কদেরকেও ছাপিয়ে গিয়েছিলেন; তাহলে হয়তোবা বিষয়টি অসত্য বা হাস্যকর মনে হবে৷

 

মোমেন মুন্না - হারিয়ে যাওয়া নায়ক

 

মোমেন মুন্নাকে নিয়ে অটো ফিস্টার যা বলেছিলেন …

He was mistakenly born in Bangladesh—তার সম্পর্কে এ কথাটি বলেছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক জার্মান কোচ অটো ফিস্টার। সেই অটো ফিস্টার, যিনি ঘানাকে বিশ্ব যুব কাপের শিরোপা এনে দিয়েছিলেন, সেই ফিস্টার যিনি আফ্রিকার দারিদ্র্যপীড়িত দেশ টোগোকে বিশ্বকাপ ফুটবলের চূড়ান্তপর্বে নিয়ে গিয়েছিলেন। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশের ফুটবলে ফিস্টারের সেই প্রিয় ফুটবলার মোনেম মুন্না’র উত্থান।

 

মোমেন মুন্না - হারিয়ে যাওয়া নায়ক

 

মোমেন মুন্নার ক্যারিয়ার …

সালটা ১৯৮৪,প্রথম দুই মৌসুম মুক্তিযোদ্ধায়। এরপর এক মৌসুম ব্রাদার্স ইউনিয়নে। ১৯৮৭ সালে তিনি যোগ দেন আকাশি নীল জার্সিধারী আবাহনী শিবিরে। দেশের ফুটবলের অন্যতম জায়ান্টেই তিনি পার করে দেন তাঁর পুরো ফুটবল ক্যারিয়ার। তিনি ছিলেন আকাশচুম্বী জনপ্রিয় এক ফুটবলার। ১৯৯১ মৌসুমের দলবদলে তিনি আবাহনীতে খেলেছিলেন ওই সময়ের বিচারে অকল্পনীয় ২০ লাখ টাকা পারিশ্রমিকে, যা অনেক দিন পর্যন্ত বাংলাদেশেই শুধু নয়, গোটা উপমহাদেশেই ছিল এক অনন্য রেকর্ড, অভাবনীয় এক ঘটনা।

জাতীয় দলের অধিনায়ক তিনি হয়েছেন একাধিকবার। ১৯৮৬ সালে সিউল এশিয়ান গেমস দিয়ে তিনি গায়ে জড়িয়েছিলেন জাতীয় দলের গর্বের জার্সি। এরপর দু-একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে তিনি জাতীয় দলে খেলেছেন টানা ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত। ১৯৯০ সালে বেইজিং এশিয়ান গেমসে তিনি প্রথমবারের মতো জাতীয় দলের অধিনায়কের আর্মব্যান্ড হাতে পরেছিলেন। তাঁর নেতৃত্বেই ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ মিয়ানমারে চার জাতি প্রতিযোগিতার শিরোপা জয় করেছিল। ওটাই ছিল আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের প্রথম কোনো শিরোপা।

 

মোমেন মুন্নার পরিবার

 

কর্পোরেট ব্রান্ড হয়ে ওঠা :

রক্ষণসেনা মোনেম মুন্না ছিলেন এক অনন্য দৃঢ় চরিত্রের ফুটবলার। পরিশ্রমী মুন্না ছিলেন আবাহনী ও জাতীয় দলের পরম নির্ভরতার প্রতীক। ফ্রি-কিক থেকে গোল করার অসামান্য ক্ষমতার অধিকারী মুন্না ছিলেন এক সেলিব্রেটি ফুটবলার। ক্রিকেট এ দেশে জনপ্রিয়তার শীর্ষে ওঠার আগে অর্থাত্ নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত মোনেম মুন্না নামটি এদেশের করপোরেট বাণিজ্যেরও অন্যতম উপাদান হিসেবে ব্যবহূত হয়েছে৷ অনেকেরই হয়ত আজও মনে আছে সেই লাইফবয় সাবানের বিজ্ঞাপন, যেখান মোমেন মুন্না হয়েছিলেন মূল চরিত্র।

মোমেন মুন্না হয়ে ওঠা

তবে, বাংলাদেশের সর্বকালের সেরা এই কিংব্যাকের ব্যাপারে জানতে হলে যেতে হবে আরেকটু পেছনে৷

নারায়ণগঞ্জ জেলা দলের সাথে বাংলাদেশ জাতীয় দলের এক প্রীতি ম্যাচে হঠাৎ নারায়ণগঞ্জের কোচ ১৪ বছর বয়সী এক কিশোরকে মাঠে নামিয়ে দেন। কোচের এমন হটকারী সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ গ্যালারীতে উপস্থিত বাফুফের উর্ধতন কর্মকর্তারা। সবাইকে অবাক করে নজরকাঁড়া পারফরম্যান্স করে সেই ১৪ বছর বয়সী কিশোর। সেদিনের সেই কিশোর বাংলাদেশ ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে সেরা ও জনপ্রিয় ফুটবলার মোনেম মুন্না।

১৯৮০-৮১ মৌসুমে পাইওনিয়ার ফুটবল লীগে নিজের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন মোনেম মুন্না। এর পরের বছর যোগ দেন দ্বিতীয় বিভাগের দল শান্তিনগরে। পেশাদার ফুটবলের অভিষেকের পর আর পিছিয়ে ফিরে তাকাতে হয় নাই। তারপর কয়েক বছর ঢাকার আরো কয়েকটি ক্লাবে খেলেন তিনি।

নিজের ফুটবল প্রতিভা দিয়ের নজর কাড়েন ঢাকা আবাহনীর কর্মকর্তা দের।১৯৮৭ সালে যোগ দেন ঢাকা আবাহনীতে। ফুটবল ক্যারিয়ারে পুরোটায় ছিলেই আকাশী নীল শিবিরে। হয়ে উঠেছিলেন ঢাকা আবাহনীর পোস্টার বয় ও সমর্থক দের নয়নের মনি।আবাহনী আর মুন্না একে অপরের পরিপূরক ছিলেন। আবাহনী ছিলো তার পুরো হৃদয় জুড়ে।

ফুটবলার মুন্নার নাম ছড়িয়ে পড়েছিল দেশে বিদেশে। আবাহনীর হয়ে দুরন্ত ফর্মে থাকা অবস্থায় কলকাতা জায়ান্ট ইস্ট বেঙ্গলে নাম লেখান বাংলাদেশ ফুটবলের গোল্ডেন বয় মুন্না। ১৯৯১ এবং ১৯৯৩ সালে কলকাতা ইস্ট বেঙ্গল হয়ে জয় করেন লীগ শিরোপা ও ফেডারেশন কাপ। মুন্নার পায়ের জাদুতে বিহ্বল ইস্ট বেঙ্গল সাপোর্টাররা আজও খবর নেয় তাদের প্রিয় মুন্না দার।

১৯৯০ দশকে সবচেয়ে জনপ্রিয় ফুটবলার ছিলেন মোনেম মুন্না। বহুজাতিক কোম্পানি তৎকালীন লিভার ব্রাদার্স বর্তমানে ইউনিলিভার তাদের কোম্পানির ব্র্যান্ড প্রতিনিধি করেন। ৯০ দশকে বিটিভিতে মুন্নার অভিনয় করা বিভিন্ন বিজ্ঞাপন প্রচারিত হত।

 

বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক ট্রফি

 

খেলোয়াড় হিসেবে আবসর ..

১৯৯৭ সালে পেশাদার ফুটবলকে বিদায় জানান মোনেম মুন্না। প্রিয় বুটজোড়া খুলে রাখলেও আকাশি নীল জার্সির প্রতি ভালোবাসা থেকে আবাহনীর ম্যানেজার হিসাবে কাজ করে যান মুন্না। ১৯৯৯ সালে তিনি কিডনি রোগে আক্রান্ত হন। জটিল কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে কিডনি বিকল হয়ে যায় কিং ব্যাক মুন্নার। ছোটবোনের কিডনি তার দেহে প্রতিস্থাপন করা হয়। ২০০৪ সালে দেহে মরণব্যাধি ধরা পড়ে। ২০০৫ সালের ১২ ফেব্রুয়ারী সকাল ৬ টায় মারা যান এই কীর্তি ফুটবলার।

মোমেন মুন্না যখন জাতীয় দলের অধিনায়ক
মোমেন মুন্না যখন জাতীয় দলের অধিনায়ক

 

৯ই জুন “কিং ব্যাক’ মোনেম মুন্নার জন্মদিন। অসময়ে চলে যাওয়া উপমহাদেশের অন্যতম আইকনিক ফুটবলার জয় করেছিলেন লাখো ভক্তের মন।

তাকে বলা হতো আবাহনীর মুন্না আর আবাহনীকে বলা হতো মুন্নার আবাহনী! মুন্না মানে শৈশবে টিভিতে দেখা লাইফবয়ের সেই এডঃ “স্বাস্থ্যকে রক্ষা করে লাইফবয়… লাইফবয় যেখানে স্বাস্থ্য সেখানে! লাইফবয়!” মুন্না হলো ফুটবলের স্বর্ণযুগের সেই শেষ উত্তরাধিকারী যার হাত থেকে রিলে দৌড়ের ব্যাটনটা হাতে তুলে নিতে পারেনি আর কেউই! ফুটবলে শুধু স্ট্রাইকার আর মিডফিল্ডারদের জয়-জয়কার, কিন্তু ব্যাকে খেলেও তারকাদের তারকা হওয়ার ব্যাতিক্রমী উদাহরণ শুধু মুন্নাই!

 

মোমেন মুন্না - হারিয়ে যাওয়া নায়ক

 

সত্যিকারের সুপারস্টারের সব কোয়ালিটি আর গ্ল্যামার কোনটার কমতি ছিলো মুন্নার মধ্যে? তাইতো দেশ ছাপিয়ে মুন্নাকে নিয়ে কাড়াকাড়ি কলকাতার ইষ্ট বেঙ্গল আর মোহনবাগানের মধ্যে, শেষে ইষ্ট বেঙ্গল মুন্নাকে পেয়ে হয় ধন্য। বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক কোন টুর্ণামেন্টের কাপ জয়ও মুন্নার নেতৃত্বে! মুন্না এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সমগ্র ক্রীড়াঙ্গনে সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক পাওয়া খেলোয়াড়,ভাবতে পারেন সেই ১৯৯২ সালে অর্থাৎ আজ থেকে ২২ বছর আগে শুধু এক মৌসুমের জন্যে আবাহনী মুন্নাকে দিয়েছিলো ২০ লাখ টাকা! বর্তমানের হিসেবে সেই ২০ লাখের ভ্যালু কি ২কোটির চেয়ে কম।

Leave a Comment