সাঁতারের নিয়মাবলী নিয়ে আজকের আলোচনা করবো। নদীমাতৃক বাংলাদেশে সাঁতার যথেষ্ট জনপ্রিয় খেলা। আবহমান কাল থেকে সাঁতার চলে আসছে। সাঁতারের সঠিক জন্ম তারিখ বলা খুবই কঠিন। তবে নদীমাতৃক বাংলাদেশে সাঁতারে যতখানি অগ্রগতি হওয়া উচিত ছিল তা বোধ করি হয়নি। আমাদের সাঁতারুরা বিশ্ব, অলিম্পিক মানতো দূরের কথা এশিয়া মানেও পৌঁছাতে পারেনি। তবে সাঁতারে অগ্রগতি সাধনের জন্য বাংলাদেশ সুইমিং ফেডারেশন সর্বদা সচেষ্ট রয়েছে। এদেশে নিয়মিত সাঁতার প্রতিযোগিতা হচ্ছে। তাছাড়া বাংলাদেশ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে যাচ্ছে।
Table of Contents
সাঁতারের নিয়মাবলী । খেলাধুলার আইন
সাঁতারের পরিচালনাকারী
সাঁতার প্রতিযোগিতার সুষ্ঠু ও নিরবিচারে আয়োজন নিশ্চিত করতে হয় একটি সুসংগঠিত কমিটির মাধ্যমে। প্রতিযোগিতা আয়োজনকারী কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গঠিত এই কমিটিই ঠিক করে দেয় কীভাবে প্রতিযোগিতা পরিচালিত হবে এবং যে কোনও বিরোধ বা সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তাদের মতামতই চূড়ান্ত বিবেচিত হয়। এই কমিটি আন্তর্জাতিক সাঁতার সংস্থা ‘ফিনা’ (FINA) এর অনুমতি সাপেক্ষে নিচের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিয়ে থাকেন:
১. রেফারি
রেফারি হলেন খেলার প্রধান নিয়ন্ত্রক। তিনি প্রতিযোগিতার পুরো সময় জুড়ে খেলোয়াড় ও অন্যান্য কর্মকর্তাদের কার্যক্রমের ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ রাখেন। ফিনার নিয়ম অনুযায়ী খেলা পরিচালনা ও সিদ্ধান্ত প্রদানের পাশাপাশি, প্রয়োজনে কোনও কর্মকর্তা নিয়োগ, বদলি বা বরখাস্ত করার ক্ষমতা তাঁর রয়েছে। এছাড়াও রেফারি বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখতে পারেন এবং সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হলে খেলা শুরুর নির্দেশ দেন।
২. আরম্ভকারী (স্টার্টার)
স্টার্টার প্রতিযোগিতার আরম্ভকালীন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকেন। তিনি রেফারির সম্মতি নিয়ে সঠিক সময়ে সিগনাল দিয়ে খেলা শুরু করান। সময় রক্ষকদের সংকেত পাওয়ার পর স্টার্টিং হুইসেল বা পিস্তলের শব্দের মাধ্যমে খেলা শুরু হয়।
৩. প্রধান টাইম-কীপার ও টাইম-কীপারগণ
প্রধান টাইম-কীপার প্রতিটি লেনে দায়িত্বপ্রাপ্ত টাইম-কীপারদের যথাস্থানে বসান এবং সময় গণনার দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন। প্রতিটি লেনে সাধারণত তিনজন টাইম-কীপার নিযুক্ত থাকেন এবং অতিরিক্ত আরও দুজন সময় রক্ষক রিজার্ভ হিসেবে থাকেন। প্রতিযোগিতার সময় ঘড়ি চালানো ও বন্ধ করার দায়িত্ব টাইম-কীপারদের। তাঁরা প্রত্যেকে নির্ধারিত কার্ডে সময় লিপিবদ্ধ করেন এবং প্রাপ্ত সময় তাৎক্ষণিকভাবে প্রধান টাইম-কীপারকে সরবরাহ করেন।
৪. প্রধান বিচারক
প্রধান বিচারকের দায়িত্ব হলো প্রতিটি বিচারকের কাজ নির্ধারণ করা ও ঘুর্ণনের জন্য ইনস্পেক্টর নিযুক্ত করা। তিনি প্রান্ত রেখায় পৌঁছার সময় বিচার নিশ্চিত করেন এবং ফলাফলে স্বাক্ষর দিয়ে তা রেফারির কাছে পাঠান। বৈদ্যুতিক ঘড়ি অকেজো হয়ে গেলে তিনিই একজন অতিরিক্ত বিচারকের দায়িত্ব পালন করতে পারেন।
৫. শেষ প্রান্তের বিচারকগণ
প্রতিটি লেনে তিনজন করে প্রান্ত বিচারক থাকেন, যারা প্রতিযোগীর শেষ অবস্থান নির্ধারণ করেন। প্রয়োজনে তারা ঘুর্ণনের ইনস্পেক্টর বা রিলে স্টার্ট পর্যবেক্ষক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তাঁরা সাধারণত পুলের এমন স্থানে অবস্থান করেন যেখান থেকে স্পষ্টভাবে সবকিছু দেখা যায়।
৬. ঘুর্ণনের ইন্সপেক্টরগণ
পুলের উভয় প্রান্তে ঘুর্ণনের ইন্সপেক্টরগণ থাকেন, যারা নিশ্চিত করেন যে প্রতিযোগীরা নিয়মমাফিক ফিরে আসছেন। রিলে ইভেন্টে সঠিকভাবে পানিতে লাফ দেওয়া এবং সীমানা ছোঁয়ার বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করেন। নির্ধারিত নিয়ম ভঙ্গ হলে তা রেফারি বা প্রধান বিচারককে জানানো হয়। দীর্ঘ দূরত্বের সাঁতার ইভেন্টে শেষ দুটি ল্যাপের জন্য সংকেত দেওয়া তাদের দায়িত্ব।
৭. স্ট্রোক বিচারক
দুইজন স্ট্রোক বিচারক রেফারির দ্বারা নিযুক্ত হন এবং পুলের বিপরীত দিক থেকে সাঁতারুদের স্ট্রোক যথাযথভাবে সম্পাদন করা হচ্ছে কি না, তা পর্যবেক্ষণ করেন।
৮. ঘোষক ও রেকর্ডার
প্রতিযোগিতায় একজন ঘোষক থাকেন, যিনি প্রতিটি খেলার ফলাফল দর্শকদের সামনে ঘোষণা করেন। অপরদিকে রেকর্ডার সমস্ত খেলার তথ্য, সময়, ফলাফলসহ অন্যান্য উপাত্ত সংরক্ষণ করেন।
৯. ক্লার্ক অব দ্য কোরস
এই কর্মকর্তা প্রতিযোগিতার নথিপত্র, সময়সূচি ও অংশগ্রহণকারীদের নাম তালিকাভুক্ত করার কাজ করে থাকেন।
জলাশয়ের মানদণ্ড
✅ ১. জলাশয়ের ধরণ
সাঁতার প্রতিযোগিতার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে দুই ধরনের পুল ব্যবহৃত হয়:
- লং কোর্ট (Long Course Pool): দৈর্ঘ্য ৫০ মিটার
- শর্ট কোর্ট (Short Course Pool): দৈর্ঘ্য ২৫ মিটার
FINA অনুমোদিত প্রতিযোগিতা এবং অলিম্পিকে ৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের পুল বাধ্যতামূলক।
📏 ২. প্রাথমিক মাত্রা ও আকৃতি
উপাদান | মানদণ্ড |
দৈর্ঘ্য (Length) | ৫০.০০ মিটার (± ০.০৩ মিটার সহনশীলতা) |
প্রস্থ (Width) | কমপক্ষে ২৫.০০ মিটার (১০ লেনের পুলে) |
লেনের সংখ্যা | সাধারণত ৮ বা ১০ |
প্রতিটি লেনের প্রস্থ | ২.৫০ মিটার |
অতিরিক্ত প্রান্ত লেন | উভয় পাশে ০.২৫ মিটার “buffer lanes” (বিশেষত ১০-লেন পুলে) |
গভীরতা (Depth) | ন্যূনতম ২.০০ মিটার (FINA ২০১৭ থেকে নতুন মান) |
🌡️ ৩. পানির মান ও তাপমাত্রা
উপাদান | মানদণ্ড |
পানির তাপমাত্রা | ২৫°C – ২৮°C (৭৭°F – ৮২.৪°F) |
পানির স্বচ্ছতা | ন্যূনতম ১.৫ মিটার গভীরতায় তলার লাইন দৃশ্যমান হতে হবে |
পিএইচ মান | ৭.২ – ৭.৬ এর মধ্যে |
ক্লোরিন মাত্রা | ১.০ – ৩.০ ppm |
🧱 ৪. প্রাচীর ও প্রান্তের গঠন
- জলাশয়ের উভয় প্রান্তে থাকতে হবে ঠাঁই দেওয়ার স্পষ্ট ও সোজা দেয়াল, যা স্বাভাবিকভাবে সাঁতারুরা স্পর্শ করে ফিরতে পারে।
- দেয়ালগুলো সমান্তরাল ও উল্লম্ব হতে হবে, এবং কোনও বাঁকা অংশ থাকা যাবে না।
- রেস্ট প্যাড বা টাচ প্যাড থাকতে পারে, যা পানি থেকে ন্যূনতম ০.৩০ মিটার উপরে ও ০.৮ মিটার নিচে বিস্তৃত হয়।
🏊♂️ ৫. লেন চিহ্ন ও বিভাজন
- প্রতিটি লেনে মাঝখানে কালো রঙের লেন মার্কিং থাকবে, যা পুলের তলায় আঁকা থাকবে (প্রস্থ ২০–৩০ সেমি)।
- পুলের প্রান্তে ‘T’ চিহ্ন থাকবে, যা ফিরতি ইঙ্গিত দেয়।
- প্রতিটি লেন লেন-রোপ (lane rope) দিয়ে পৃথক থাকবে, যা লো রেজিস্ট্যান্স বাফার হিসেবে কাজ করে এবং পানি ঢেউ কমাতে সাহায্য করে।
⚡ ৬. আলো ও সাউন্ড ব্যবস্থা
- ন্যূনতম ১৫০০ লাক্স আলোকসজ্জা থাকতে হবে আন্তর্জাতিক টিভি সম্প্রচারের জন্য।
- আরম্ভের সংকেত (Starters tone or flash system) দৃষ্টিশক্তিহীন সাঁতারুদের জন্যও সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা থাকতে হবে।
- সাউন্ড সিস্টেম হবে ওয়াটারপ্রুফ, যাতে সবাই আরম্ভের সংকেত একসাথে পায়।
🧯 ৭. নিরাপত্তা ও সহায়ক ব্যবস্থা
- প্রত্যেক প্রান্তে জীবন রক্ষাকারী/লাইফগার্ড বাধ্যতামূলক।
- প্রথম চিকিৎসা ও অক্সিজেন সাপোর্ট সহজপ্রাপ্য থাকতে হবে।
- প্রয়োজনে ব্যবহারযোগ্য র্যাম্প বা লিফট ব্যবস্থা থাকবে প্রতিবন্ধী প্রতিযোগীদের জন্য।
🧪 ৮. জল বিশুদ্ধকরণ ব্যবস্থা
- ফিল্টারেশন ও সার্কুলেশন সিস্টেম থাকবে যাতে ৬ ঘণ্টার মধ্যে পুরো পানি পুনঃচক্রিত হয়।
- পানিতে কোনও ধরনের ফেনা, তেলাক্ততা বা অস্বচ্ছতা থাকবে না।
🔧 ৯. সময় পরিমাপক যন্ত্র (Timing System)
- অলিম্পিক ও বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ পর্যায়ে FINA অনুমোদিত Fully Automatic Timing System (FATS) বাধ্যতামূলক।
- এর মধ্যে থাকবে:
- স্টার্ট সিস্টেম
- টাচ প্যাড
- ফলাফল বোর্ড
- ব্যাকআপ টাইমিং ইউনিট
📷 ১০. সম্প্রচার ও ক্যামেরা ব্যবস্থা
- অলিম্পিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আন্ডারওয়াটার ক্যামেরা সংযুক্ত থাকে।
- ড্রোন, লং রেঞ্জ ও হাই স্পিড ক্যামেরাও ব্যবহৃত হয় সম্প্রচারের মান বৃদ্ধিতে।
সাঁতারের প্রতিযোগিতায় আন্তর্জাতিক মান নিশ্চিত করতে হলে শুধু প্রতিযোগী নয়, পুল ব্যবস্থাপনাও হতে হবে বিজ্ঞানভিত্তিক ও নির্ভুল। উপযুক্ত জলাশয় না থাকলে প্রতিযোগীরা তাদের সর্বোচ্চ দক্ষতা দেখাতে ব্যর্থ হয়। তাই প্রতিটি আয়োজক সংস্থার উচিত, FINA-এর নির্দেশিকা মেনে পূর্ণাঙ্গ জলাশয় তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করা। এর মাধ্যমে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রতিযোগিতায় মান বজায় থাকবে, সাঁতারুরা নিরাপদে ও সেরা পরিবেশে তাদের নৈপুণ্য দেখাতে পারবে।
🏊♀️ লেনের সংখ্যা ও কাঠামো
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী প্রতিযোগিতামূলক সাঁতারের জন্য পুলে থাকতে হবে ন্যূনতম ৮টি স্বতন্ত্র লেন।
🔹 পুলের প্রস্থ:
৮ লেন বিশিষ্ট পুলের প্রস্থ হবে ২৫ মিটার, যেখানে প্রতিটি লেনের প্রস্থ ২.৫০ মিটার।
🔹 বাফার স্পেস:
উভয় প্রান্তে অতিরিক্ত ০.২৫ মিটার করে ফাঁকা জায়গা থাকবে, যা প্রতিযোগীদের ঢেউ নিরোধ ও নিরাপত্তার জন্য ব্যবহৃত হবে।
🔹 লেন বিভাজক দড়ি (Lane Ropes):
- প্রতিটি লেন আলাদা করতে শক্ত ভাসমান দড়ি বা লেন রোপ ব্যবহার করা হয়।
- এই দড়িগুলো সাধারণত প্লাস্টিক ডিস্ক বা রিং যুক্ত থাকে, যা ঢেউ ভাঙতে সাহায্য করে।
- দড়ির পরিধি হবে ০.০৫ মিটার থেকে ০.১০ মিটার এর মধ্যে।
- এক দড়ি থেকে আরেকটির দূরত্ব হবে ঠিক ৫ মিটার— অর্থাৎ প্রতিটি লেন ২.৫০ মিটার প্রস্থের সঙ্গে এদিক-ওদিক না হয়।
🏁 আরম্ভ পদ্ধতি (Starting Procedure)
সাঁতারের আরম্ভ পদ্ধতি প্রতিযোগিতার সফলতা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সঠিক আরম্ভ না হলে পুরো রেস বাতিল হতে পারে।
🔸 সাধারণ নিয়ম:
- পিঠ সাঁতার (Backstroke) এবং রিলে ইভেন্টের পিঠ সাঁতারে পুলের ভেতর থেকে শুরু হয়।
- অন্যান্য সকল সাঁতারে প্রতিযোগীরা স্টার্টিং ব্লক থেকে ডাইভ দিয়ে শুরু করেন।
🔸 আরম্ভের নির্দেশনা:
- রেফারির সংকেতের পর আরম্ভকারী বলেন: “Take your marks”
- প্রতিযোগীরা প্রস্তুত অবস্থায় থাকেন এবং পুরোপুরি স্থির হওয়ার পর স্টার্টিং সিগন্যাল (বিপ শব্দ বা গুলি আওয়াজ) দেওয়া হয়।
🔸 ফলস স্টার্ট (False Start):
- কেউ সিগন্যালের আগে ডাইভ দিলে তা ফলস স্টার্ট হিসেবে গণ্য হবে।
- প্রথমবার সতর্ক করা হয়, তবে একাধিকবার একই ভুল করলে সেই প্রতিযোগীকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়।
🧪 ট্রায়াল হিট বা বাছাইপর্ব
ট্রায়াল হিট হলো মূল প্রতিযোগিতার জন্য অংশগ্রহণকারীদের প্রাথমিক বাছাইপর্ব। আন্তর্জাতিক সাঁতারে অংশগ্রহণকারী বেশি হলে এই হিটের প্রয়োজন হয়।
(ক) নাম লিপিবদ্ধকরণ:
- যে প্রতিযোগী আগে রিপোর্ট করবেন, তার নাম তালিকার শুরুতে লেখা হবে।
- যারা পরে রিপোর্ট করবেন, তাদের নাম পরে লেখা হবে।
- যারা অনুপস্থিত, তাদের সর্বনিম্ন অনুমেয় সময় ধরে পরে নাম লেখানো হবে।
(খ) সময়ভিত্তিক শ্রেণিবিন্যাস:
- প্রতিযোগীদের পূর্ববর্তী সময় (seeding time) অনুযায়ী দ্রুত থেকে ধীরে এইভাবে হিট সাজানো হবে:
- সবচেয়ে দ্রুত সাঁতারু বা দল শেষ হিটে রাখা হবে।
(গ) লেন বণ্টন পদ্ধতি:
- হিটে থাকা প্রতিযোগীদের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুত সাঁতারুকে মাঝখানের লেনে (লেন ৪) রাখা হবে।
- ধীরে ধীরে বাইরের দিকের লেনগুলো বরাদ্দ দেওয়া হবে— উদাহরণস্বরূপ:
- যদি ৮ লেন হয়, দ্রুত সাঁতারু পাবেন ৪ নম্বর লেন, এরপর ৫, ৩, ৬, ২, ৭, ১, ৮ এই ক্রমে।
(ঘ) বাছাইয়ের ধরণ অনুযায়ী লেন বণ্টন:
- যদি প্রাথমিক বাছাই (Preliminary Seeding) হয়ে থাকে, তাহলে চূড়ান্ত হিটে (Final Heat) লেন বণ্টন হবে (গ) অনুযায়ী।
- যদি কোনো প্রাথমিক বাছাই না থাকে, তাহলে (ক) অনুযায়ী সরাসরি হিট তৈরি করা হবে।
👩⚖️ বিচারকদের ভূমিকা:
- কোন লেনে কে থাকবে তা চূড়ান্ত করবেন দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারক (Judge)।
- মতবিরোধ দেখা দিলে রেফারি হস্তক্ষেপ করবেন এবং তার সিদ্ধান্তই হবে চূড়ান্ত।
সাতারের সাধারণ নিয়ম
সাঁতার একটি শৃঙ্খলাপূর্ণ ও নিয়মভিত্তিক প্রতিযোগিতা। সাঁতারে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি প্রতিযোগীকে নির্ধারিত কিছু সাধারণ নিয়ম মেনে চলতে হয়। এই নিয়মগুলো ভঙ্গ করলে তা “ফাউল” হিসেবে বিবেচিত হয় এবং রেফারি প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট প্রতিযোগী বা দলকে অযোগ্য (Disqualified) ঘোষণা করতে পারেন। নিচে সাঁতারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ সাধারণ নিয়ম তুলে ধরা হলো:
১. ❌ অন্য প্রতিযোগীকে বাধা দেওয়া নিষেধ
- কোনো প্রতিযোগী যদি অন্য প্রতিযোগীর গতিপথে ইচ্ছাকৃতভাবে বাধা প্রদান করেন, তাকে ফাউল করা হবে।
- শারীরিক ধাক্কা, পুলে হাত বা পা ছুঁইয়ে অন্যকে থামানো বা পানির তরঙ্গ ছুড়ে অন্যকে বিভ্রান্ত করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
- এমন আচরণ প্রমাণিত হলে রেফারি তাকে তৎক্ষণাৎ বাতিল করতে পারেন।
২. 🔁 ফাউল করলে ইভেন্ট পুনরায় আয়োজন
- কোনো প্রতিযোগী ফাউল করলেও যদি সে বিজয়ের কাছাকাছি থাকেন এবং প্রভাব অন্যদের ওপর পড়েছে—তাহলে রেফারি ও বিচারকমণ্ডলী সিদ্ধান্ত নিয়ে ইভেন্টটি পুনরায় আয়োজন করতে পারেন।
- এটি একমাত্র তখনই করা হয় যদি ঘটনাটি প্রকৃত প্রতিযোগিতার স্বাভাবিকতা ভেঙে ফেলে।
৩. 🧱 ঘূর্ণনের সময় দেয়াল স্পর্শ
- প্রতিটি ঘূর্ণনের সময় (turning point) প্রতিযোগীকে অন্তত একটি হাত (backstroke/butterfly) বা দুটি হাত (breaststroke) দিয়ে পুলের দেয়াল স্পর্শ করতে হয়।
- দেয়াল স্পর্শ না করলে প্রতিযোগী বাতিল বলে গণ্য হবেন।
৪. 🧱 শেষ ল্যাপে দেয়াল স্পর্শ না করলে জয় বাতিল
- প্রতিযোগিতা শেষে ফিনিশিং মুহূর্তে দেয়াল স্পর্শ করাই বিজয়ের চিহ্ন।
- কেউ যদি শেষ ল্যাপে দেয়াল স্পর্শ না করেন, তিনি বিজয়ী বলে গণ্য হবেন না, যদিও অন্যদের চেয়ে আগে পৌঁছান।
৫. 🤝 রিলে সাঁতারে সহকর্মীর অপেক্ষা
- রিলে সাঁতার (Relay Events)-এ পরবর্তী সাঁতারু তখনই পুলে ঝাঁপ দিতে পারবেন, যখন পূর্ববর্তী সাঁতারু দেয়াল স্পর্শ করবেন।
- দেয়াল স্পর্শের আগে লাফ দিলে তা “False Takeoff” হিসেবে গণ্য হবে এবং সম্পূর্ণ দল বাতিল করা হবে।
৬. ⛔ পানিতে ভেসে থাকার কোনো ডিভাইস নিষিদ্ধ
- প্রতিযোগী কোনো ধরনের ফ্লোটেশন ডিভাইস (যেমন—পানির বেল্ট, প্যাডল বা ফ্লিপার) ব্যবহার করতে পারবেন না।
- এমনকি বডি-সুট বা সাঁতারের চশমার বিশেষ বৈশিষ্ট্য থাকলেও তা FINA অনুমোদিত হতে হবে।
৭. 📏 নির্ধারিত দূরত্ব আবশ্যকভাবে সাঁতার দিতে হবে
- প্রতিযোগীকে অবশ্যই পুরো নির্ধারিত দূরত্ব সাঁতার কেটে শেষ করতে হবে।
- দূরত্ব কম হলে বা ভুলভাবে শেষ করলে তাকে বাতিল করা হবে।
৮. 🧭 নির্ধারিত লেন অনুসরণ করা বাধ্যতামূলক
- প্রতিযোগীকে নিজের নির্ধারিত লেনে শুরু করতে হবে এবং একই লেনেই প্রতিযোগিতা শেষ করতে হবে।
- মাঝপথে লেন পরিবর্তন করা যাবে না। করলে তা অবৈধ বলে বিবেচিত হবে।
সাঁতারের প্রকারভেদ ও প্রতিযোগিতার ধরন
সাঁতার প্রতিযোগিতায় মূলত চারটি প্রধান স্ট্রোক বা ভঙ্গিতে সাঁতার হয়: ফ্রি-স্টাইল, ব্রেস্ট স্ট্রোক, বাটারফ্লাই ও ব্যাক স্ট্রোক। প্রতিটি স্ট্রোকেরই রয়েছে আলাদা আলাদা নিয়ম, কৌশল ও টেকনিক। নিচে এগুলো বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো।
ফ্রি-স্টাইল (Free Style)
ফ্রি-স্টাইল হলো সাঁতারের সবচেয়ে দ্রুততম ও স্বাধীন ভঙ্গি। এখানে সাঁতারুরা সাধারণত ‘ক্রল’ ভঙ্গিতে সাঁতার কাটে। সাঁতারুর দেহের পেছনের দিকটি পানির উপরে থাকে এবং দুই হাত পালাক্রমে মাথার উপর দিয়ে পানি টেনে নেয়। শ্বাস নিতে মাঝে মাঝে মুখ উপরে তুলে নেওয়া হয় এবং পা দিয়ে ধারাবাহিকভাবে কিক করা হয়। আন্তর্জাতিকভাবে ফ্রি-স্টাইলে সাঁতারের সময় দেহ সর্বদা পানির সমতলে থাকবে এবং টার্ন ও সমাপ্তির সময় দেয়াল স্পর্শ বাধ্যতামূলক।
ব্রেস্ট স্ট্রোক (Breast Stroke)
ব্রেস্ট স্ট্রোক, বাংলায় বুক সাঁতার নামে পরিচিত। এতে দুই হাত বুকের কাছ থেকে সামনে ঠেলে দিয়ে আধা-বৃত্তাকারে বাইরে ও নিচে আনা হয় এবং শরীর সামনের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়। পা দু’টি ব্যাঙের মতো ভাঁজ করে ছড়িয়ে আবার টেনে আনা হয়। এই স্ট্রোকে মাথা প্রায়শই পানির উপরে থাকে। প্রতিটি টার্ন ও ফিনিশে দুই হাত একসাথে দেয়াল স্পর্শ করতেই হবে, যা নিয়মগতভাবে বাধ্যতামূলক।
বাটারফ্লাই (Butterfly)
বাটারফ্লাই স্ট্রোক সবচেয়ে কষ্টসাধ্য এবং শক্তির ব্যবহারবহুল। এখানে দুই হাত একসঙ্গে মাথার উপর দিয়ে সামনে ফেলে আবার পানি টেনে পেছনে আনা হয়। পা দু’টি একত্রে রেখে উপরে-নিচে সাপের মতো গতিতে ওঠানামা করে (ডলফিন কিক)। দেহের ভারসাম্য বুকের উপর কেন্দ্রীভূত থাকে। প্রতিটি টার্ন ও সমাপ্তির সময় দুই হাত একত্রে দেয়ালে ছোঁয়াতে হয়।
ব্যাক স্ট্রোক (Back Stroke)
ব্যাক স্ট্রোক, বা চিৎ সাঁতার, একমাত্র সাঁতার যেটি পিঠের দিকে শুয়ে শুরু হয়। সাঁতারুরা দেয়াল ধরে প্রস্তুত হয় এবং স্টার্টারের সংকেতে দেয়াল ঠেলে পেছনে সাঁতার শুরু করে। হাত পালাক্রমে মাথার উপর দিয়ে টেনে পেছনের দিকে নেয়া হয় এবং পা দিয়ে টানা কিক করা হয়। প্রতিটি টার্নে সাঁতারুরা দেয়াল স্পর্শ করেই ঘুরবে।
অন্যান্য সাধারণ নিয়মাবলী
১. প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী সাঁতারু নিজ নিজ লেনেই শুরু ও শেষ করবে।
২. রিলে ইভেন্টে আগের সাঁতারু দেয়াল স্পর্শ না করলে পরবর্তী সাঁতারু শুরু করতে পারবে না।
৩. প্রতিযোগিতার সময় সাঁতারুর সঙ্গে পানিতে ভেসে থাকার কোনো যন্ত্র, যেমন ফ্লোট বা প্যাড ব্যবহার করা যাবে না।
৪. প্রতিটি টার্ন ও সমাপ্তিতে দেয়াল স্পর্শ করা বাধ্যতামূলক।
৫. কোনো সাঁতারু ইচ্ছাকৃতভাবে অন্য প্রতিযোগীকে বাঁধা দিলে তাকে অযোগ্য ঘোষণা করা হবে।
সাঁতারের প্রধান প্রতিযোগিতা ও দূরত্ব
প্রতিযোগিতার নাম | দূরত্ব (মিটার) |
ফ্রি স্টাইল | ১০০, ২০০, ৪০০, ৮০০, ১৫০০ |
ব্রেস্ট স্ট্রোক | ১০০, ২০০ |
বাটারফ্লাই | ১০০, ২০০ |
ব্যাক স্ট্রোক | ১০০, ২০০ |
ব্যক্তিগত মিডলে | ২০০, ৪০০ |
ফ্রি স্টাইল রিলে | ৪ x ১০০, ৪ x ২০০ |
মিডলে রিলে | ৪ x ১০০ |
ব্যক্তিগত মিডলে ইভেন্টে চারটি ভঙ্গি একের পর এক অনুসরণ করতে হয়: বাটারফ্লাই, ব্যাক স্ট্রোক, ব্রেস্ট স্ট্রোক ও ফ্রি স্টাইল।
সাঁতারের কিছু বাস্তবিক টিপস
সাঁতার প্রতিযোগিতার পূর্বে মধু বা হালকা শক্তিদায়ক খাবার যেমন ডিম, দুধ ও কফি খাওয়া উপকারী হতে পারে। খেলা শেষে পানি থেকে উঠে শরীরে হালকা গরম কিছু জড়িয়ে রাখা উচিত যাতে ঠাণ্ডা না লাগে।